স্নেহাশীষ মুখার্জি, আমাদের ভারত, নদিয়া, ১৪ নভেম্বর: একদিকে গোলাপ, অন্যদিকে শিশু, দুটি জিনিস ছিল নেহেরুর প্রিয়। মায়া, মমতা ব্যক্তিত্ব ও সৌজন্যতার কারণে ছোটো ছোটো বাচ্চাদের মধ্যে শুরু থেকেই তিনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ স্বভাবের জন্য বাচ্চারা সহজেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হত। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু শিশুদের খুব পছন্দ করতেন, যখনই তিনি বড় বড় কাজের শেষে অবসর সময় পেতেন, তিনি শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। তিনি যেখানে গেছেন, শিশুদের দেখেছেন, সেখানেই তিনি গাড়ি থেকে নেমে পড়েছেন। শিশুদের কোলে তুলে নিয়েছেন। শিশুরাও তাঁকে আদর করে ‘চাচা নেহেরু’ বলে ডাকতো। জওহরলাল নেহরু বিশ্বাস করতেন যে শিশুরা একটি জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই তাদের সবার আগে শিক্ষার অধিকার দেওয়া উচিত।
প্রদীপ মারিকের লিখিত তথ্য থেকে জানতে পারা যায়, পণ্ডিত নেহরু বলতেন, আজকের শিশুরাই আগামী দিনে শ্রেষ্ঠ ভারত তৈরি করবে। নেহেরু আরো বলতেন, যেভাবে তাদের লালন-পালন করব তা দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। আধুনিক ভারত কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে তাঁর একটি স্পষ্ট দৃষ্টি ছিল, ও এর জন্য তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছিলেন যে শক্তিশালী স্তম্ভ স্থাপন করা হবে যা তখনকার সদ্য স্বাধীন দেশের কাজে লাগবে। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বাচ্চাদের শিক্ষায় প্রবল জোর দিয়েছিলেন ও বিশ্বাস করেছিলেন যে একটি সদ্য স্বাধীন ভারত শিশুদের সমৃদ্ধির পাশাপাশি উন্নতি করতে পারে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, শিশুরা জাতির মেরন্দণ্ড। শিশুরা সেই মেরুদণ্ড যার ভিত্তিতে মানব জাতির ভবিষ্যত দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মঙ্গল ও বৃদ্ধি সম্মিলিতভাবে পুরো মানবতার বিকাশ সুনিশ্চিত করে। যে উত্তরাধিকার গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করি তা হ’ল এই প্রত্যাশায় যে একদিনের ভবিষ্যত প্রজন্ম তার উপকারগুলি কাটাতে পারে।
১৮৮৯ সালের ১৪ নভেম্বর, উত্তরপ্রদেশের এলাহবাদে প্রখ্যাত আইনজীবী ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মতিলাল নেহরুর ছেলে জওহরলাল নেহরুর জন্ম হয়। হ্যারো স্কুলে পড়াশোনা করে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে ডিগ্রি অর্জনের জন্য ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি দেন। এই সময়ে তিনি সাহিত্য, অর্থনীতি, ইতিহাস ও রাজনীতির বিষয়ে পাঠ নেন। সেই জন্যই তাঁর মধ্যে উদারতাবাদ, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের প্রতি তাঁর আগ্রহ বাড়ে। ১৯১২ সালে ভারতে ফিরে আসেন ও এলাহাবাদ হাইকোর্টে যোগদান করেন। তাঁকে আদর করে চাচা বলে ডাকা হত। ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার এক নতুন দিশা দেখান তিনি। তাঁর নেতৃত্বেই ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি অ্যাক্ট পাস হয়েছিল। ভারতকে বিশ্ব মানচিত্রে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে জওহরলাল নেহরুর বিশ্বজনীন চেতনা প্রবলভাবে কাজ করেছিল। তিনি বলতেন, জীবনে ভয়ের মতো খারাপ ও বিপজ্জনক কিছু সম্ভবত নেই। ব্যর্থতা তখনই আসে, যখন আমরা আমাদের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও নীতি ভুলে যাই। অনুগত ও দক্ষ কাজ একটি মহান কারণ, যদিও এটি অবিলম্বে স্বীকৃত নাও হতে পারে, অবশেষে ফল বহন করে। ইংরেজ শাসক জেনারেল ডায়ারের জালিয়ানওয়ালাবাগে নৃশংস গণহত্যায় তিনি আর নিজেকে সংযত রাখতে পারেননি, স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন বুকে নিয়ে সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে। ওই সময় পণ্ডিত নেহরুকে ৯ বার জেলবন্দিও করে ব্রিটিশ প্রশাসন। তাঁর গোটা জীবনের মোট ৩,২৫৯ দিন অন্ধকার কারাগারের পেছনেই জেল বন্দি হিসাবে কেটেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের তিনি প্রায় ৯ বছর কারাবন্দি থাকেন।
জেলবন্দি থাকার সময় ‘টুয়ার্ডস ফ্রিডম’ নামে তিনি এক আত্মজীবনীও লিখেছিলেন। আত্মজীবনী টুওয়ার্ড ফ্রিডম, জওহরলাল নেহরু ১৯৩৪ সালের জুন থেকে ফেব্রুয়ারি ১৯৩৫ সালের মধ্যে কারাগারে বন্দি থাকার সময় লিখেছিলেন। টুওয়ার্ড ফ্রিডম মুখবন্ধে নেহরু তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলিকে স্পষ্ট করেছিলেন, কারণ সেই সময় গঠনমূলকভাবে ভারতের অতীতের ঘটনাগুলি পর্যালোচনা করে ‘আত্ম-প্রশ্ন করার’ দরকার তিনি উপলব্ধি করেন। কারা জীবনের কঠিন সংগ্রামেও নিজের মানসিক বিকাশ বৃদ্ধির বিশেষ প্রয়োজন উপলব্ধি করেন। তাঁর আত্মজীবনীতে দেশবাসীর কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। বিদেশি পাঠকের কথা তিনি চিন্তা করেননি। বইটিতে ৬৮টি অধ্যায় রয়েছে, যার প্রথম শিরোনাম ‘কাশ্মীর থেকে বংশোদ্ভূত’। ১৭১৬ সালে কাশ্মীর থেকে দিল্লিতে তাঁর পূর্বপুরুষদের অভিবাসন ও ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পরে আগ্রায় তাঁর পরিবারের বসতি স্থাপনের ব্যাখ্যা দিয়ে শুরু করেন। ব্রিটিশ সরকার ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগে কর্মরত এমজি হ্যালেটকে বইটির পর্যালোচনা করার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন। বইটি নিষিদ্ধ করা উচিত কিনা, তা বিচার করবার জন্য। এমজি হ্যালেট বললেন, নেহরু কারাগারের মূর্তি ও বিমূর্তি প্রতীক হিসেবে প্রত্যেকটি অধ্যায় যে ভাবে অন্তর্ভুক্ত করেছে তা ‘খুবই মানবিক’ ছিল। ওয়াল্টার ক্রোকারের মতে, নেহরু যদি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুপরিচিত না হতেন, তাহলে তিনি তাঁর আত্মজীবনীর জন্য বিখ্যাত হতেন। স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর পদে বসানো হয় নেহরুকে। এই পদে বসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি শক্ত হাতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তখন তা নিয়ে বিদ্রূপ করা হলেও পরে দেখা গেছে, ভারতের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তোলার জন্য তাঁর এই ধরনের পদক্ষেপ গুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শিক্ষা থেকে শিল্প সব দিকেই তিনি দৃষ্টি দিয়েছিলেন। তাঁর তত্বাবধানেই নাঙ্গল বাঁধ, রিহান্দ বাঁধ ও বোকারুতে ইস্পাত কারখানা গড়ে উঠেছিল। ১৯৫১- ৫৬-সালে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সূচনা হয়েছিল। প্রথম দিকে এই পরিকল্পনা কতটা সার্থক হবে সেই নিয়ে সবার মনেই সংশয় ছিল, কিন্তু ১৯৫৬ সালে ফলাফল দেখার পর আশার আলো জ্বলে সবার মনে। সেই সঙ্গে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণও বাড়তে থাকে। কৃষির কথা মাথায় রেখে গড়ে তোলা হয়েছিল প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মাথায় রাখা হয়েছিল শিল্পকে। দক্ষিণ ভারত যখন পৃথক দেশ হিসাবে নিজেদের গড়ে তোলার দাবি জানাচ্ছিল, তখন তিনি ‘এক ঐক্য ভারত, অখণ্ড ভারত ‘এর কথা বলেছিলেন। স্বাধীন ভারতের সত্ত্বা অটুট রাখার জন্য নেহরু স্বচেষ্ট ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ভারত নিজের স্বাধীন বিদেশ নীতি বজায় রাখবে, কখনই তার বিসর্জন দেবে না। ১৪ নভেম্বর নেহরু জন্মজয়ন্তীর পাশাপাশি দেশজুড়ে পালিত হয় শিশুদিবস। রাষ্ট্রসংঘ ১৯৫৪ সালের ২০ নভেম্বর দিনটিকে শিশু দিবস হিসাবে পালনের জন্যে ঘোষণা করেছিল। নদিয়ার কৃষ্ণনগরের পৌরসভার উদ্যোগে সেই ঘোষণা অনুযায়ী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ২০ নভেম্বর দিনটিই শিশু দিবস হিসাবে পালন করেছিল। তবে ১৯৬৪ সালের ২৭ মে, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর প্রয়াণের পর সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে প্রতি বছর ১৪ই নভেম্বর, শিশুদের প্রিয় চাচা নেহরুর জন্মদিনকেই শিশু দিবস হিসাবে উদযাপিত করা হবে ভারতে। সেই থেকেই ১৪ই নভেম্বর শিশু দিবস পালিত হয়ে আসছে ভারতে। নদিয়ার আসাননগর এর একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে স্থানীয় ঢাকুরিয়া পোতা এলাকায় শিশুদেরকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গোলাপ ফুল উপহার দিয়ে চাচা নেহরুর জন্মদিন পালন করল। এমনই এক শিশু যার বয়স মাত্র এক বছর সেই স্বপ্নীল বিশ্বাসকে গোলাপ উপহার দিয়ে নেহেরুর জন্মদিন পালন করল একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ছোট্ট স্বপ্নীল গোলাপ হাতে পেয়ে আনন্দে গদগদ। সেই আনন্দের ছবি ক্যামেরাবন্দি হল।
পাশাপাশি নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের শিবনিবাস মহাশ্মশানে মহাশ্মশান কমিটির উদ্যোগে শিশু দিবস পালন করা হয়। শিশু দিবসের পাশাপাশি শিশুদের নিয়ে বনভোজন করা হয়।আমরাও চাই প্রতি বছর এ ধরনের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শিশুদের কে নিয়ে নেহেরুর জন্মদিন পালন করুক। তবেই তো হবে চাচা নেহরুর জন্মদিনের অর্থাৎ শিশু দিবস পালনের সার্থকতা।