অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, ১৯ মার্চ: ভারতের চন্দ্রজয়ের এই যুগেও ওঁদের জীবন চরকাময়। ওঁদের মানে নাসিমা বিবি (৬৯), মনোয়ারা বেগম (৫৪), কবিতা গোস্বামী (৫৬), রুপা দে (৫৯) প্রমুখ। এঁরা বহু বছর ধরে কাজ করছেন বাঁকুড়ার গ্রাম স্বরাজ সংঘে। লোকচক্ষুর প্রায় আড়ালে তিন দশক পূর্ণ হল বাঁকুড়ায় এই চরকা বিপ্লবের।
মহাত্মা গান্ধী মনে করতেন চরকা একটি অস্ত্র। পরমাণু বোমার মতো দানবিক অস্ত্র নয়, দৈব অস্ত্র। চরকা এমন এক হাতিয়ার, যা ভিতর থেকে বদলে দিতে পারে মানুষকে। দেশকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতেও পারে চরকা।
তা বাঁকুড়ায় এই চরকা বিপ্লবের সূত্রপাত কীভাবে? আসলে এই জেলায় স্বাধীনতা আন্দোলনে অহিংস কার্যক্রম প্রাধান্য পেয়েছিল। নানা বয়সের অনেক পুরুষ-মহিলা জড়িয়ে পড়েন এতে। এঁদের মধ্যে ছিলেন গান্ধী আদর্শে অনুপ্রাণিত গৌরী রায় ও তাঁর স্বামী প্রমোদ রায়। ওঁরাই মূলত ছিলেন বাঁকুড়ায় এই চরকা বিপ্লবের নেপথ্য-দম্পতি।
ওঁদের পুত্র কল্যাণ রায় ১৯৫৬-তে তৈরি বাঁকুড়া গান্ধী বিচার পারিষদের সম্পাদক। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, “ওঁরা ঝাড়গ্রামে লোধা জাতিদের নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। বিহারের দেওঘরের পার্ডি ও ব্যারাকপুরে মেথর, ঝাড়ুদার বস্তির হরিজন ও বাউড়ি বাচ্চাদের প্রাথমিক শিক্ষা দানে যুক্ত ছিলেন। মা নিজে গাছ থেকে কার্পাস তুলো সংগ্রহ করে তুলোর পাইজ করে চরকা বক্সে সুতো কেটে তাঁতিদের দিয়ে খাদির থান করিয়ে আমাদের জামা-পাঞ্জাবি পরিয়েছে। বলতে গেলে অনেক কিছু আছে!”
গৌরী রায়ের সেই চরকা বক্স ঠাঁই পেয়েছে বাঁকুড়ার বিপ্লবী সংগ্রহশালায় কাঁচের শোকেসে দ্রষ্টব্য হিসাবে। কল্যাণ রায় এই প্রতিবেদককে বলেন, “মা মারা গেছেন ২০১১-র ১২ ডিসেম্বর। বাবা প্রয়াত হয়েছেন আরও আগে। এই পরিষদ এবং গ্রাম স্বরাজ সংঘ একটি বৃন্তে দুটি ফুল। ১৯৯৪ সাল থেকে শুরু এই চরকা কাটা। বাঁকুড়ায় প্রথম দিকে গ্রামে গ্রামে ছিল। নানা অসুবিধা হাওয়ায় পরবর্তীকালে এক জায়গায় বসে কাটার কাজ শুরু হয়।
১৭ মার্চ বাঁকুড়া ডিস্ট্রিক্ট প্রেস ক্লাবের সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসবে আমাকে সম্বর্ধনা জানানোর এবং একটি বিশেষ বিষয়ে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানেই হদিশ পাই বাঁকুড়ার গান্ধী সংগ্রহশালা এবং বিপ্লবী সংগ্রহশালার। সেই দুটি দেখতে গিয়ে জানলাম, বাঁকুড়ায় চরকা বিপ্লবের।
বিশদ জানার আগ্রহে কল্যাণবাবু বলেন, “চরকাগুলোর নানা ধরণ আছে। অম্বর চরকা, এনএমসি চরকা। বক্স চরকা এখন আর চলে না। এখানে মহিলারা গড়ে মাসে ৪০ কাউন্টের ১৫০০ লাছি সুতো তৈরী করেন। মাসে ২৪০০ থেকে ৩ হাজার টাকা আয় হয়। ছুটির দিন বাদ দিলে রোজ গড়ে ৫ ঘন্টা কাজ করেন। ওদের জন্য বড় ঘর ও জল-বাথরুমের সব ব্যাবস্থা আছে।”
কেন চরকা ব্যবহার ভারতীয়দের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন মহাত্মা? এর পিছনে রয়েছে তাঁর নিজস্ব ‘নির্মাণের দর্শন’। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী চরকাকে একটা আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন৷ এই মূল নিহিত রয়েছে ব্রিটিশ শাসনে ভারতের সম্পদ লুণ্ঠনের গভীরে। ইংরেজদের প্রধান ব্যবসা ছিল আধুনিক মেশিনে তৈরি কাপড়ের৷ ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশের বাজার
ছেয়ে ফেলে ব্রিটিশ মিলে তৈরি কাপড় দিয়ে। ফলে এই দেশের চরকায় সুতো কেটে তা দিয়ে হাতেবোনা তাঁতের কাপড়ের যে বিশাল ঐতিহ্য ও বাজার ছিল তা প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়৷ সেই সঙ্গে ছিল কৃষকদের উপর নির্যাতন। এই সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবেই গান্ধীজী চরকায় সুতো কাটাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
কারা কেনে চরকায় কাটা এই সুতো? কল্যাণবাবুর জবাব, “যা সুতো হয় তা আমাদের কিছু গ্রামের তাঁতির কাছে পাঠানো হয় কাপড়ের থান তৈরি করার জন্য।” মুর্শিদাবাদ, মালদা, বীরভূম, নদীয়া, বর্ধমান, পুরুলিয়াতে আছে চরকা কাটার এরকম আসর। এটি কেন্দ্রীয় সরকারের খাদি গ্রামোদ্যোগ আয়োগের অন্তর্ভুক্ত। খাদি দফতরের সমন্বয়ে ও সহযোগিতায় চলে এই কার্যক্রম।”