Agmeswari, Santipur, মা আগমেশ্বরীর অলৌকিক ঘটনা

স্নেহাশীষ মুখার্জি, নদিয়া, ৩০ অক্টোবর: প্রায় ৪০০ বছর আগে তন্ত্রসার গ্রন্থের সংকলনকর্তা পন্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের বংশধর প্রপুত্র সার্বভৌম আগমবাগীশ শান্তিপুরে তাঁর আরাধ্যা দেবী মহাকালীর প্রতিষ্ঠা করেন।
সার্বভৌম কিন্তু সাধারণ ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি ছিলেন তন্ত্র শাস্ত্রে সুপন্ডিত ও তন্ত্রসাধক।তন্ত্রসাধক আগমবাগীশের নামানুসারেই পরে ওই দেবী আগমেশ্বরী নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।

মাতা আগমেশ্বরীর সূচনা করেছিলেন পন্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। এই কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ নবদ্বীপের বাসিন্দা। তিনি তন্ত্রসার গ্রন্থ রচনা করেছিলেন অর্থাৎ তান্ত্রিকের নির্দিষ্ট পুজো বিধি। তিনি ধ্যানযোগে তার আরাধ্যা দেবীর মূর্তি দেখেছিলেন সেই মূর্তিকেই তিনি মাতা আগমেশ্বরীর মধ্যে চিহ্নিত করেছিলেন। যখন তিনি ধ্যান করছিলেন সেই সময় তিনি ধানের মধ্য দিয়ে দেবীর আদেশে জানতে পারেন যে আগামীকাল প্রত্যুষে তুই যাকে দেখতে পাবি সেই তোর আরাধ্যা দেবী। সেই অনুযায়ী তিনি ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলে দেখেন কালো এক কন্যা একহাতে গোবর নিয়ে অন্য হাতে ঘুঁটে দিচ্ছে দেওয়ালে, ওনাকে দেখে উনি লজ্জায় জিভ কেটে ফেললেন। কৃষ্ণানন্দের মনে হলো উনিই হচ্ছেন তাঁর আরাধ্যা দেবী কালী। উনি পরে সেই দেবীর মূর্তি গঙ্গা মৃত্তিকায় নির্মাণ করলেন এবং নির্মাণ করে পুজো করার সেই রাতেই তিনি তাঁকে বিসর্জন দিয়ে দিলেন। সেই থেকে প্রথম দক্ষিণা কালীর সৃষ্টি হলো মূর্তি গড়িয়ে।

আগমবাগীশের প্রপৌত্র সার্বভৌম আগমবাগীশ শান্তিপুরে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সার্বভৌম হলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের প্রপৌত্র। তাঁরা শাক্ত ছিলেন। কিন্তু শান্তিপুরে অদ্বৈতাচার্যের পৌত্র মথুরেশ গোস্বামী চেয়েছিলেন তদানীন্তন কালে শাক্ত এবং বৈষ্ণবের মধ্যে বিরোধটা দূর করতে। তাই তিনি তার মেয়ের বিয়ে দেন সার্বভৌম আগমবাগীশের সঙ্গে। কিন্তু তদা নিয়ন্ত্রণ শাক্ত সমাজ এই বিষয়টা ভালোভাবে মেনে নেননি। মেনে না নেওয়ার ফলে তাদের সংসারে নানা সমস্যা দেখা দিতে শুরু করল। পরে তিনি মেয়ে জামাইকে নবদ্বীপ থেকে নিয়ে আসেন শান্তিপুরে। শান্তিপুরের বড় গোস্বামী পরিবার যেহেতু প্রত্যক্ষভাবে শক্তির উপাসনা করেন না সেহেতু মথুরেশ গোস্বামী সেই সময় তার বাড়ির কাছেই পূর্ব দিকে একটি পঞ্চমুন্ডীর আসন স্থাপন করেন। সেখানেই সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করেন সার্বভৌম আগমবাগীশ। তিনিও সাধনায় অনুরূপভাবে মূর্তি দেখলেন এবং শান্তিপুরে মা আগমেশ্বরীর প্রতিষ্ঠা করলেন। কৃষ্ণচন্দ্র আগমবাগীশ যে ধ্যান রীতি রচনা করেছিলেন সেই ধ্যান রীতিতে বলা হয় মার কর্ণের পাশ দিয়ে দুটি শব শিশু ভয়ানক রূপে বিরাজ করছে। এখানে সার্বভৌমের নিয়মানুযায়ী একদিনে মূর্তি তৈরি করা হত, কিন্তু এখন যেহেতু মূর্তি অনেক বড় সেই কারণে কৃষ্ণপক্ষ পরার পর মূর্তির কাজ শুরু হয়। ৮-১০ দিনের মধ্যে মায়ের মূর্তি তৈরি হয় এবং পুজোর দিন মৃৎশিল্পী সুবীর পাল চক্ষুদান করে নিচে নেমে আসেন। তারপরই পুজো শুরু হয়। সেই রীতি আছে এবং পুজো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘট বিসর্জন হয়ে যায় পরে মূর্তি নিরঞ্জন হয়।

শান্তিপুর তথা বাংলায় ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, বহু দূর দূরান্ত থেকে এখানে ভক্তরা আসেন তাদের মনোষ্কামনা জানাতে। দেবীকে নানান ধরনের স্বর্ণালংকার টাকা-পয়সা মিষ্টি বাতাসা ভক্তরা দিয়ে যান। আনুমানিক ১০-১২ লক্ষ টাকা প্রতি বছর এই পুজোতে খরচ হয়। এই টাকাটা পুরোটাই ভক্তদের প্রদেয় দান। জোর করে কারো কাছ থেকে পুজোর চাঁদা নেওয়া হয় না। পুজো কমিটির অফিসে এসে ভক্তরা তাঁদের সাধ্যমত চাঁদা দিয়ে যান। গত বছরে ১৪ কুইন্টাল পুষ্পান্ন ভক্তদের বিলি করা হয়েছে। এবারেও পুষ্পান্নের পরিমাণ অপরিবর্তিত আছে। বাড়ির দীক্ষিত মহিলারাই মায়ের ভোগ রান্না করেন। মাকে ৩৬ রকমের ভোগ দেওয়া হয়। এঁচোড়ের ডালনা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মোচার ঘন্ট, পটলের তরকারি, আলুর দম, শুক্ত ভোগের মধ্যে থাকবেই। শান্তিপুরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে পুজো পরিচালনার জন্য একটি উপদেষ্টা মন্ডলী আছে। মূলত বড় গোস্বামী বাড়ির উত্তর পুরুষ এই পুজোর পরিচালনার দায়িত্বে। তাদের মাথার উপর শান্তিপুরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি এই পুজো পরিচালনা করে। আগে করিবরগার বাড়ির মত মন্দিরটা ছিল। মানুষের বসবাসের উপযোগী ছিল না। ঘন জঙ্গলের মধ্যে ছিল। বর্তমানে ২৫-৩০ বছর এই মন্দিরটি সংস্কার করা হয়েছে। বড় গোস্বামী বাড়ির শ্বশুরকূল এই পুজোর পরিচালনা করে। আগে মশালের আলো দিয়ে প্রতিমা নিরঞ্জন হতো কিন্তু পরবর্তীকালে প্রশাসনিক নির্দেশে তারা মশাল বন্ধ করে দেয়। তবে প্রতিটি মশাল হিসেবে এখনো দুটি মশাল জ্বালানো হয়, কিছু সময়ের জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *