ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ২৪ জানুয়ারি: পানিহাটির গঙ্গার ধারের একটি দ্বিতল বাড়ি। কবি প্রথম এসেছিলেন ১৮৭২ সালে। ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে তাকে স্মরণীয় করে রেখেছেন তিনি। জীবনের অন্তিমে পৌঁছে ১৯৪১ সালের ৩১ শে জানুয়ারি যখন ‘আরোগ্য’ কবিতাটি লিখলেন তখনও পেনেটির বাগানবাড়ির ছবি স্পষ্ট হয়েই ধরা দিল।
খুবই প্রাচীন জনপদ ‘পণ্যহট্ট’, তা থেকে ‘পানিহাটি’, চলতি কথায় ‘পেনেটি’। রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত সেই বাড়িটির বর্তমান নাম ‘গোবিন্দকুমার হোম’, এখন মহিলাদের অনাথাশ্রম। রবীন্দ্রনাথ এই বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে একাধিকবার সাময়িক অবস্থান করেছেন। কলকাতায় তখন ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাব। ডেঙ্গুর হাত থেকে রেহাই পেতে ঠাকুর পরিবারের বারেবারে পেনেটি-বাস।
জানা যায়, ১৮৭২, ১৮৭৪ এবং ১৮৭৮ সালে তিনি পরিবারের সঙ্গে এখানে এসেছেন। বাগান ও বাড়ির এই স্মৃতি এতটাই প্রভাববিস্তার করেছিল তাঁর বালকমনে, আলোচনা প্রসঙ্গে বারেবারে পেনেটি-বাসের কথা উপস্থাপিত করেছেন তিনি। শহরের আবদ্ধ জীবন থেকে প্রথম মুক্তির স্বাদ এগারো বছর বয়সে পানিহাটিতেই পেয়েছিলেন। পানিহাটি তাই ইঁটকাঠের অরণ্য থেকে অবারিত আকাশে এক রাবীন্দ্রিক-মুক্তি। ‘আশ্রমের রূপবিকাশ’-এ তিনি লিখছেন, “..কলকাতায় একবার যখন ডেঙ্গুজ্বর সংক্রামক হয়ে উঠেছিল তখন আমার গুরুজনদের সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিলাম গঙ্গার ধারে লালাবাবুদের বাগানে।” ‘জীবনস্মৃতি’-তে লিখলেন, “একবার কলিকাতায় ডেঙ্গুজ্বরের তাড়নায় আমাদের বৃহৎ পরিবারের কিয়দংশ পেনেটিতে ছাতুবাবুদের বাগানে আশ্রয় লইল। আমরা তাহার মধ্যে ছিলাম। এই প্রথম বাহিরে গেলাম। গঙ্গার তীরভূমি যেন কোন পূর্বাজন্মের পরিচয়ে আমাকে কোলে করিয়া লইল। সেখানে চাকরদের ঘরটির সামনে গোটাকয়েক পেয়ারাগাছ। সেই ছায়াতলে বারান্দায় বসিয়া সেই পেয়ারাবনের অন্তরাল দিয়া গঙ্গার ধারার দিকে চাহিয়া আমার দিন কাটিত।”
পানিহাটির গঙ্গার ধারের বাড়িটিতে তিনি কখন কখন আসেন?
১. ১৮৭২ সালের ১৪ ই মে থেকে ৩০ শে জুন পর্যন্ত এই বাড়িতে অবস্থান করেন রবীন্দ্রনাথ। তখন বাড়ির নাম ‘মোক্ষধাম’। বাড়ির মালিক উপেন্দ্রমোহিনী দাসী। বাড়িভাড়া ছিল মাসিক ১২৫ টাকা। বাড়িভাড়ার টাকা দেওয়া হয়েছিল লালবাবু বা জনৈক লালচাঁদ মল্লিকের মাধ্যমে। ১ লা জুলাই ঠাকুর পরিবার গাড়ি করে কলকাতায় ফিরে যায়। এই সময় কবির বয়স মাত্র ১১ বছর। পরিবারের সঙ্গেই ছিলেন জ্যোতিদাদা বা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রমুখ। বাড়ির পুকুরে বালক রবীন্দ্রনাথ সাঁতার শিখেছেন। জানা যায়, ১৮৭৪ সালের জুনমাসে এবং ১৮৭৮ সালের গ্রীষ্মকালেও ডেঙ্গুর হাত থেকে বাঁচতে ঠাকুর পরিবার কিছুদিন পেনেটিতে বসবাস করেছিলেন। ১৮৮৬ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের শেরপুরের জমিদার গোবিন্দকুমার চৌধুরী এই বাড়িটি কিনে নেন।
২. ১৯১৯ সালের এপ্রিল মাসের শেষে কবি একবার আসেন এই বাড়িতে। তার আগে ১৩ এপ্রিল সংঘটিত জালিয়ানওয়ালাবাগের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের কথা জেনেছেন তিনি। মন বিষণ্ণ, কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেন। কলকাতায় এলেন ২২ শে মে। তারপর নাইটহুড বর্জনের চিঠি দিলেন ব্রিটিশ সরকারকে। এরপর মানসিক শান্তির খোঁজে এলেন এই বাড়ি। একাকী থাকবেন কিছুদিন। সঙ্গে প্রশান্ত চন্দ্র। কিন্তু বাড়ির সেই রূপ আর নেই। বাগানবাড়িটির মালিকানা তখন বনোয়ারি (লাল চৌধুরী) বাবুর এক শরিকের হেপাজতে। মালিকের সঙ্গে কথা বলা ছিল। কবি এলেন। মালিরা দরজাও খুলে দিলেন। সেই বাগান নেই, আছে কয়েকটি শুধু পুরোনো গাছ। চারিদিকে দেখে, গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে থেকে, পুকুরটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে, দোতালার ঘর ঘুরে প্রশান্তচন্দ্রকে বললেন, “…এবার চলো। কিছু নেই। সেই পেনেটির বাগানে আর ফেরা যায় না।”
৩. ১৯৩৩ সালের ৫ ই মার্চ রবীন্দ্রনাথ এই বাড়িতে আবার আসেন। সঙ্গে ভাগ্নি সরলা দেবী চৌধুরানী। তখন এই বাড়িটি দুঃস্থ মহিলাদের একটি অনাথাশ্রম হয়ে গেছে। নাম ‘গোবিন্দকুমার হোম’। ১৯২৮ সালের ২৯ শে মার্চ থেকে বোর্ড অফ ট্রাস্টির দায়িত্বে এসেছে এই হোম। তারই এক অনাথ মেয়ের বিবাহ উপলক্ষে তিনি আমন্ত্রিত। দিনটিকে স্মরণে রাখতে আয়োজকরা কবিকে দিয়ে গঙ্গার ধারে একটি আমগাছ রোপণ করিয়েছিলেন।
৪. ১৯৩৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাসন্তী কটন মিলের উদ্বোধন উপলক্ষে পানিহাটিতে রবীন্দ্রনাথ এলেন। সভাপতিত্ব করেছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। উপস্থিত ছিলেন ডাক্তার নীলরতন সরকার, বাসন্তী দেবী, মেয়র নলিনীরঞ্জন সরকার প্রমুখ ব্যক্তিত্ব। সেদিনও কবি একবার এই বাড়িটিতে ঘুরে যান।
রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থের ‘বাহিরে যাত্রা’-র কিয়দংশ পরিবেশন করছি। তাতে পানিহাটির সেই সময়কার ছবি ফুটে উঠবে। “প্রত্যহ প্রভাতে ঘুম হইতে উঠিবামাত্র আমার কেমন মনে হইত, যেন দিনটাকে একখানি সোনালিপাড়-দেওয়া নূতন চিঠির মতো পাইলাম। লেফাফা খুলিয়া ফেলিলে যেন কী অপূর্ব খবর পাওয়া যাইবে। পাছে একটুও কিছু লোকসান হয় এই আগ্রহে তাড়াতাড়ি মুখ ধুইয়া বাহিরে আসিয়া চৌকি লইয়া বসিতাম। প্রতিদিন গঙ্গার উপর সেই জোয়ারভাঁটার আসা যাওয়া, সেই কত রকম-রকম নৌকার কত গতিভঙ্গি, সেই পেয়ারাগাছের ছায়ার পশ্চিম হইতে পূর্বদিকে অপসারণ, সেই কোন্নগরের পারে শ্রেণীবদ্ধ বনান্ধকারের উপর বিদীর্ণবক্ষ সূর্যাস্তকালের অজস্র স্বর্ণশোণিতপ্লাবন। এক-একদিন সকাল হইতে মেঘ করিয়া আসে; ওপারের গাছগুলি কালো; নদীর উপর কালো ছায়া; দেখিতে দেখিতে সশব্দ বৃষ্টির ধারায় দিগন্ত ঝাপসা হইয়া যায়, ওপারের তটরেখা যেন চোখের জলে বিদায়গ্রহণ করে; নদী ফুলিয়া উঠে এবং ভিজা হাওয়া এপারের ডালপালাগুলার মধ্যে যা-খুশি-তাই করিয়া বেড়ায়।
কড়ি-বরগা দেয়ালের জঠরের মধ্য হইতে বাহিরের জগতে যেন নূতন জন্মলাভ করিলাম। সকল জিনিসকেই আর-একবার নূতন করিয়া জানিতে গিয়া, পৃথিবীর উপর হইতে অভ্যাসের তুচ্ছতার আবরণ একেবারে ঘুচিয়া গেল। সকালবেলায় এখোগুড় দিয়া যে বাসি লুচি খাইতাম, নিশ্চয়ই স্বর্গলোকে ইন্দ্র যে-অমৃত খাইয়া থাকেন তাহার সঙ্গে তার স্বাদের বিশেষ কিছু পার্থক্য নাই। কারণ, অমৃত জিনিসটা রসের মধ্যে নাই, রসবোধের মধ্যেই আছে– এইজন্য যাহারা সেটাকে খোঁজে তাহারা সেটাকে পায়ই না।
যেখানে আমরা বসিতাম তাহার পিছনে প্রাচীর দিয়া ঘেরা ঘাটবাঁধানো একটা খিড়কির পুকুর− ঘাটের পাশেই একটা মস্ত জামরুল গাছ; চারিধারেই বড়ো বড়ো ফলের গাছ ঘন হইয়া দাঁড়াইয়া ছায়ার আড়ালে পুষ্করিণীটির আবরু রচনা করিয়া আছে। এই ঢাকা, ঘেরা, ছায়া-করা, সংকুচিত একটুখানি খিড়কির বাগানের ঘোমটা-পরা সৌন্দর্য আমার কাছে ভারি মনোহর ছিল। সম্মুখের উদার গঙ্গাতীরের সঙ্গে এর কতই তফাত। এ যেন ঘরের বধু। কোণের আড়ালে, নিজের হাতের লতাপাতা আঁকা সবুজরঙের কাঁথাটি মেলিয়া দিয়া মধ্যাহ্নের নিভৃত অবকাশে মনের কথাটিকে মৃদুগুঞ্জনে ব্যক্ত করিতেছে। সেই মধ্যাহ্নেই অনেকদিন জামরুলগাছের ছায়ায়, ঘাটে একলা বসিয়া পুকুরের গভীর তলাটার মধ্যে যক্ষপুরীর ভয়ের রাজ্য কল্পনা করিয়াছি।
বাংলাদেশের পাড়াগাঁটাকে ভালো করিয়া দেখিবার জন্য অনেক দিন হইতে মনে আমার ঔৎসুক্য ছিল। গ্রামের ঘরবস্তি চণ্ডীমণ্ডপ রাস্তাঘাট খেলাধুলা হাটমাঠ জীবনযাত্রার কল্পনা আমার হৃদয়কে অত্যন্ত টানিত। সেই পাড়াগাঁ এই গঙ্গাতীরের বাগানের ঠিক একেবারে পশ্চাতেই ছিল− কিন্তু সেখানে আমাদের যাওয়া নিষেধ। আমরা বাহিরে আসিয়াছি কিন্তু স্বাধীনতা পাই নাই। ছিলাম খাঁচায়, এখন বসিয়াছি দাঁড়ে− পায়ের শিকল কাটিল না।
একদিন আমার অভিভাবকের মধ্যে দুইজনে সকালে পাড়ায় বেড়াইতে গিয়াছিলেন। আমি কৌতূহলের আবেগ সামলাইতে না পারিয়া তাঁহাদের অগোচরে পিছনে পিছনে কিছুদূর গিয়াছিলাম। গ্রামের গলিতে ঘনবনের ছায়ায় শেওড়ার-বেড়া-দেওয়া পানাপুকুরের ধার দিয়া চলিতে চলিতে বড়ো আনন্দে এই ছবি মনের মধ্যে আঁকিয়া আঁকিয়া লইতেছিলাম। একজন লোক অত বেলায় পুকুরের ধারে খোলা গায়ে দাঁতন করিতেছিল, তাহা আজও আমার মনে রহিয়া গিয়াছে। এমন সময়ে আমার অগ্রবর্তীরা হঠাৎ টের পাইলেন, আমি পিছনে আছি। তখনই ভর্ৎসনা করিয়া উঠিলেন, “যাও যাও, একনি ফিরে যাও।”− তাঁহাদের মনে হইয়াছিল বাহির হইবার মতো সাজ আমার ছিল না। পায়ে আমার মোজা নাই, গায়ে একখানি জামার উপর অন্য-কোনো ভদ্র আচ্ছাদন নাই− ইহাকে তাঁহারা আমার অপরাধ বলিয়া গণ্য করিলেন। কিন্তু মোজা এবং পোশাকপরিচ্ছদের কোনো উপসর্গ আমার ছিলই না, সুতরাং কেবল সেইদিনই যে হতাশ হইয়া আমাকে ফিরিতে হইল তাহা নহে, ত্রুটি সংশোধন করিয়া ভবিষ্যতে আর-একদিন বাহির হইবার উপায়ও রহিল না।
সেই পিছনে আমার বাধা রহিল কিন্তু গঙ্গা সম্মুখ হইতে আমার সমস্ত বন্ধন হরণ করিয়া লইলেন। পাল-তোলা নৌকায় যখন-তখন আমার মন বিনাভাড়ায় সওয়ারি হইয়া বসিত এবং যে-সব দেশে যাত্রা করিয়া বাহির হইত, ভূগোলে আজ পর্যন্ত তাহাদের কোনো পরিচয় পাওয়া যায় নাই।
সে হয়তো আজ চল্লিশ বছরের কথা। তার পর সেই বাগানের পুষ্পিত চাঁপাতলার স্নানের ঘাটে আর একদিনের জন্যও পদার্পণ করি নাই। সেই গাছপালা, সেই বাড়িঘর নিশ্চয়ই এখনো আছে, কিন্তু জানি সে বাগান আর নাই; কেননা, বাগান তো গাছপালা দিয়া তৈরি নয়, একটি বালকের নববিস্ময়ের আনন্দ দিয়া সে গড়া− সেই নববিস্ময়টি এখন কোথায় পাওয়া যাইবে? জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আবার ফিরিলাম। আমার দিনগুলি নর্মাল স্কুলের হাঁ-করা মুখবিবরের মধ্যে তাহার প্রাত্যহিক বরাদ্দ গ্রাসপিণ্ডের মতো প্রবেশ করিতে লাগিল।”
তথ্যপঞ্জি: ১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ভাদ্র, ১৩১৮- শ্রাবণ, ১৩১৯; প্রবাসী/১৩১৯ গ্রন্থ/পুনর্মুদ্রণ ১৩৮৭), জীবনস্মৃতি (বাহিরে যাত্রা), বিশ্বভারতী, পৃষ্ঠা: ২৪-২৬. ২. শান্তা শ্রীমানী ২০২১, ঠাকুরবাড়ির স্মৃতিবিজড়িত বাগানবাড়ি, পত্রলেখা, কলকাতা, পৃষ্ঠা: ৩২-৩৫. ৩. কানাইপদ রায় ২০০৩, বারাকপুর মহকুমা এবং রবীন্দ্রনাথ, অংশুমান প্রকাশন, কলকাতা, পৃষ্ঠা : ১-১৩.