সোমনাথ বরাট, আমাদের ভারত, বাঁকুড়া, ৩১ মার্চ: গরম পড়তে না পড়তেই বাঁকুড়া জেলার একের পর এক বনভূমিতে আগুন লাগার ঘটনায় উদ্বিগ্ন বনদপ্তর থেকে বনবাসীরা, উদ্বিগ্ন পরিবেশবাদীরা।
গত মার্চ মাসে জেলার ৬টিরও বেশি বনভূমিতে ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনা আটকাতে বনদপ্তরের পাশাপাশি পরিবেশবাদীরা সংলগ্ন গ্রামগুলির বাসিন্দাদের সচেতনতার প্রসার ঘটাতে উদ্যোগ নিয়েছে। বনে আগুন লাগার ফলে কুরকুরে, শিক ছাতু, পিয়াল, বনকুল ও মধুর উৎপাদন কমছে। এর ফলে বন সংলগ্ন গ্রামগুলির বাসিন্দাদের জীবিকা ও জীবন বিঘ্নিত হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত ৬ মার্চ জেলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র শুশুনিয়া পাহাড়ের জঙ্গলে আগুন লাগে। এই আগুন নিয়ন্ত্রনে আনতে ২৪ ঘন্টারও বেশি সময় লাগে। পাহাড়ের পাথর গরম হয়ে পড়ে। উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র এবং পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়। শুশুনিয়ার ঘটনার এক সপ্তাহ কাটতে না কাটতেই জেলার আর এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বনভূমিতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। গত ১৩ মার্চ জেলার জঙ্গলমহল এলাকার রানিবাঁধ ব্লকের বারো মাইল জঙ্গলে আগুন লাগে। এই দুটি ক্ষেত্রেই জঙ্গলের শুকনো ঝরা পাতায় আগুন জ্বলতে দেখে স্থানীয় অধিবাসীরা খবর দেন বন দফতরের। বন দফতরের কর্মীরা ব্লোয়ার হাতে আগুন নেভানোর কাজে নামেন।
বন্যপ্রাণ সমৃদ্ধ বনাঞ্চল হিসাবে পরিচিত বারো মাইল জঙ্গল। এই জঙ্গলে হরিণ, ময়ূর, বুনো শুকর, সজারু ছাড়াও নানা প্রজাতির জীবজন্তু, পাখি ও সরিসৃপ রয়েছে। এই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে ফের আগুন লাগে জেলার আর এক গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল সোনামুখীতে। গত ১৮ মার্চ আগুন লাগে সোনামুখীর জঙ্গলে। হঠাৎ করেই সোনামুখীর জঙ্গল দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করে। সাধারণ মানুষের দাবি, এই কাজে বন দপ্তরের নজরদারির অভাব রয়েছে। মানুষকে আরও সচেতন করা প্রয়োজন রয়েছে।
সোনামুখীর বিট অফিসার ইদ্রিস সরকার জানান, কেউ যাতে গাছে বা জঙ্গলে আগুন না লাগায় তার জন্য এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে। বন দপ্তরের কর্মীরাও দফায় দফায় টহল দিচ্ছেন। তা সত্বেও এই ঘটনা ঘটছে। গত ২৭ মার্চ কাঞ্চনপুর বনাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় আগুন লাগে। আবার গত রবিবার ৩০ মার্চ সুতান জঙ্গলে ভয়াবহ আগুন লাগে। আজও সেই আগুন জ্বলতে থাকে। সুতান, জেলার উল্লেখযোগ্য জঙ্গল। উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণী বৈচিত্রের জন্য উল্লেখযোগ্য। এই আগুন লেগে যাওয়ার ঘটনা আটকাতে পরিবেশবাদী সংস্থা মাই ডিয়ার ট্রিজ অ্যান্ড ওয়াইল্ডস শিল্পীদের দিয়ে গান, নাটক ও নাচের মাধ্যমে বনসংলগ্ন গ্রামগুলির বাসিন্দাদের সচেতনতার প্রসার ঘটাতে প্রচার চালাচ্ছে। গত রবি ও সোমবার বেলিয়াতোড়ে দুদিনের এক কর্মশালার আয়োজন করে পরিবেশবাদী সংস্থাটি। এই কর্মশালায় কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের আয়োজিত এনভায়রনমেন্টাল মিউজিক ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা সোনামুখি,বড়জোড়া, বেলিয়াতোড়, কাঞ্চনপুর ও শুশুনিয়া এলাকার শিল্পীদের বনে আগুন রোধে গান, নাটক ও গীতিআলেখ্য রচনা ও তৈরির প্রশিক্ষণ দেন।
বর্ষাকাল থেকে পরবর্তী গরমকাল পর্যন্ত জেলার বনভূমি সংলগ্ন গ্রামগুলির বাসিন্দাদের কাছে আয়ের ভান্ডার হয়ে ওঠে। বর্ষাকালে অধিকাংশ বনভূমিতে বিশেষ করে শাল ও মহুয়ার জঙ্গলে প্রচুর পরিমাণে কুরকুরে ছাতু ও শিক বা কাড়ান ছাতু পাওয়া যায়। এই সব ছাতু সুস্বাদু ও পুষ্টিকরই নয়, এই সব ছাতু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কুরকুরে ছাতু ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। তাছাড়া বাজারে এই বনজ ছাতুর চড়া দাম ও চাহিদা রয়েছে। অথচ বন আগুনে পুড়ে যাওয়ার ফলে এই সব ছাতু উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তাছাড়া মধুর উৎপাদন কমছে। এসব বনভূমিতে একসময় প্রচুর পরিমাণে পিয়াল, বনকুল পাওয়া যেত। বন আগুনের ফলে সেগুলির উৎপাদন কমেছে। বনে আগুন লাগায় সংলগ্ন গ্রামবাসীদের জীবন ও জীবিকা উভয়ের ওপর আঘাত। বনে আগুনের কারণে সাপ সহ বিভিন্ন বন্য প্রাণী লোকালয়ে আশ্রয় নেয়। সেখানে তারা মানুষের হাতে বা যানবাহনের চাকায় চাপা পড়ে মারা যায়।অন্যদিকে সাপের কামড়ে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। তাই বন আগুন লেগে যাওয়ার ঘটনা আটকাতে এলাকার অধিবাসীদের তৎপর হতে হবে। এই কর্মশালায় সেই বিষয়ে গান, নাটক ও গীতি আলেখ্য রচনা ও তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
সোনামুখির লোকশিল্পী প্রভাতী দাস ও তন্ময় কর, কাঞ্চনপুরের অনাথ রায় ও কেলেবোলার কার্তিক পাল জানান, গান ও নাটকে পরিবেশ সুরক্ষার বার্তা এত সুন্দর ও শক্তিশালি ভাবে পাঠানো যায়, তা মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া যায়। এই কর্মশালয় বন আগুন রোধের বার্তা তুলে ধরতে ৫টি গান, ১টি নাচ ও ১টি নাটক তৈরি করা হয়েছে। সেগুলি নিয়ে প্রচারে নামবেন শিল্পীরা।