সোমনাথ বরাট, আমাদের ভারত, বাঁকুড়া, ১ জুলাই: বন দপ্তরের নির্দেশ অনুসারে সূর্য ডোবার পর থেকে সকাল পর্যন্ত বনভূমি থেকে কাঠ বহন নিষিদ্ধ। এজন্য বনদপ্তরের নজরদারিও রয়েছে, তা সত্বেও জেলার বিভিন্ন বনভূমি থেকে রাতের অন্ধকারে অবাধে কাঠ পাচার হচ্ছে। এর ফলে বন দপ্তরের ভূমিকা নিয়ে গ্রামবাসী এমনকি বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যরা বন দপ্তরের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন।
গত রবিবার বাঁকুড়া সদর মহকুমার বেলননি উপরবাদি গ্রাম সংলগ্ন জঙ্গল থেকে কাঠ পাচার আটকে দেয় বন কমিটির সদস্যরা। তারা কাঠসহ একটি পিকআপ ভ্যানকে আটক করে বন দপ্তরের হাতে তুলে দেয়। বন কমিটির সদস্যদের মতে কাঠ পাচারের ঘটনা আগেও ৪ থেকে ৫ বার ঘটেছে। বন দপ্তরকে জানালেও কোনো লাভ হয়নি। পাচারকারীরা অবাদে কাঠ নিয়ে চলে গেছে। তাই এবার পাচারকারীদের গাড়ি আটকে রেখে বন দপ্তরে খবর দেওয়া হয়েছিল। একটি পিকআপ ভ্যান ও কাঠ আটক করে নিয়ে যায় বন দপ্তর।
বেলবনির উপরবাদির স্থানীয় মানুষরা জানিয়েছেন, যে রবিবার গভীর রাতে গাছ কেটে একটি পিকআপ ভ্যানে করে কাঠ পাচারের চেষ্টা করছিল দুষ্কৃতীরা। পিকআপ ভ্যানটি কাদায় আটকে পড়ে। এতে কাঠ বোঝাই গাড়ি ফেলেই চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা। গ্রামবাসীরা কাঠ বোঝাই গাড়িটিকে ধরে বন দপ্তরের হাতে তুলে দেয়।
উল্লেখ্য, উপরবাদি গ্রামে ঢোকার মুখে ইউক্যালিপটাস গাছের জঙ্গল রয়েছে। এই জঙ্গল থেকে মাঝেমধ্যেই রাতের অন্ধকারে গাছ কেটে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে গ্রামবাসীদের অভিযোগ। তাই গ্রামবাসীরাই বন সুরক্ষা কমিটি গড়ে জঙ্গল দেখভাল করছেন। বন দপ্তরের তরফে এই জঙ্গল কাটা হলে লভ্যাংশের একাংশ তারা পাবেন। কাঠ পাচার হওয়ায় সেই লাভ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যদের অভিযোগ, জেলায় জঙ্গল থেকে কাঠ পাচারের ঘটনায় অনেক সময় ‘সর্ষের মধ্যেই ভূত’ লুকিয়ে থাকছে। তাই তারা সতর্ক রয়েছে। সম্প্রতি খাতড়া ও সিমলাপালে পাচারের সময় কাঠ ভর্তি দু’টি গাড়ি ধরা পড়ে। এই দুটি ঘটনায় বন কর্মীদের একাংশ জড়িত থাকতে পারে বলে অভিযেগ উঠেছিল। এনিয়ে বিভাগীয় তদন্তও হয়।
বন সুরক্ষা কমিটির সদস্য ও জেলাবাসীর একাংশে ধারণা বনদপ্তরের সদ্য কাটা সরকারি গাছ পাচার হচ্ছে। কাঠ পাচারের সময় সংশ্লিষ্ট এলাকায় আইন- শৃঙ্খলার সমস্যা সৃষ্টি হয়। এতে বনদপ্তরের ভূমিকা নিয়ে জেলার পুলিশ ও প্রশাসনিক মহলেও প্রশ্ন উঠতে শুরু করে।
বাঁকুড়া দক্ষিণের ডিএফও প্রদীপ বাউরি জানান, সম্প্রতি সিমলাপালে চোরাই কাঠ বোঝাই একটি ট্রাক আটক করা হয়। পাঞ্চেত বনবিভাগ এলাকা থেকে শাল কাঠ বোঝাই করে পাচার করা হচ্ছিল। এই ঘটনার মাত্র দু’দিন পরে খাতড়ায় আকাশমণি কাঠ পাচারের চেষ্টা হয়। দু’টি ক্ষেত্রেই কয়েক লক্ষ টাকার কাঠ সহ গাড়িগুলিকে আটক করা হয়েছে। মালিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিভাগীয় তদন্তও শুরু হয়েছে। তিনি বলেন যে, সূর্যোদয়ের পূর্বে ও সূর্যাস্তের পরে গাছ কাটা বা জঙ্গল থেকে কাঠ পরিবহণ করা যায় না।
বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যদের বক্তব্য, দু’টি ক্ষেত্রেই ওই নিয়ম মানা হয়নি। এমনকি খাতড়ায় বনদপ্তরের এলাকায় থাকা জঙ্গলের গাছ কেটে ফেলে রাখা হয়েছিল। সেই কাঠ বোঝাই করে একটি পিকআপ ভ্যানে পাচার করা হচ্ছিল। এই পাচার বন দপ্তরের কর্মী ও আধিকারিকদের নজর কিভাবে এড়িয়ে গিয়েছিল সে নিয়েও প্রশ্ন তুলেন তারা।
উল্লেখ্য, বাঁকুড়া দক্ষিণ বন বিভাগের সঙ্গে পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম ও পুরুলিয়া জেলার বিভিন্ন রেঞ্জের সীমানা মিশে রয়েছে।সেই কারণে এই এলাকা কাঠ মাফিয়াদের নজরে রয়েছে। ঝিলিমিলি, সুতান, বারিকুল এলাকা একসময় কাঠ পাচারের করিডর ছিল। বাম আমলে মাওবাদী আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে মাফিয়ারা জঙ্গলের শাল, সেগুন সহ অন্যান্য দামি গাছ দেদার কেটে পাচার করত বলে অভিযোগ। পুলিশ ও বনদপ্তরের কর্মীরা সেই সময় জঙ্গলের বহু দুর্গম এলাকায় ঢুকতে পারত না। সেই সুযোগকে মাফিয়ারা কাজে লাগাত। রাজ্যে ক্ষমতা বদলের পর সাময়িক তা বন্ধ হলেও ফের তা শুরু হয়েছে। বনদপ্তর, পুলিশ প্রশাসন ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের একাংশ তাদের মদত দিচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠছে।