Durga Puja, Mallabhum, প্রাচীন রীতি অনুযায়ী আজ কৃষ্ণা নবমী তিথিতে মল্লভূমে শুরু হল দুর্গাপূজা

সোমনাথ বরাট, আমাদের ভারত, বাঁকুড়া, ২৭ সেপ্টেম্বর: রাজপরিবারের রীতি মেনে আজ থেকে মল্লভূমে শুরু হয়ে গেল দুর্গাপূজা। রাজা ও রাজত্ব কোনটা না থাকলেও প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী কৃষ্ণানবমী তিথিতে স্থানীয় মাধব সায়েরে মহাস্নান সেরে মল্ল কুলদেবী মৃন্ময়ী বড় ঠাকুরানি আসেন মন্দিরে। এই সময় প্রথা মেনে মাধব সায়রের পাড়ে গর্জে ওঠে কামান। ঢাক-ঢোল, কাঁসর, সানাইয়ের সুরে দেবীর আগমন হয় মন্দিরে।দেবীর মহাস্নান দেখতে মাধবসায়েরের পাড়ে ভক্ত ও কৌতুহলী দর্শকদের ভিড় জমে ওঠে। এই সময় থাকে কড়া নিরাপত্তা।

১০২৮ বছরের প্রাচীন রীতি মেনে কূলদেবী মৃন্ময়ীর পূজা দুর্গাপূজ শুরু হওয়ার ১৫ দিন আগে কৃষ্ণা নবমীতে কুলদেবী মৃন্ময়ী পুজো শুরু হয় মল্লভূমের রাজধানী বিষ্ণুপুরে। এদিন সকালে বিষ্ণুপুরের ফৌজদার পরিবারের হাতে আঁকা বড় ঠাকুরানির পট নিয়ে রাজপুরোহিতরা উপস্থিত হন রাজদরবার লাগোয়া মাধব সায়রে। এটাই একহাজার বছরের পুরাতন রীতি। এই সময় মাধবসায়েরে হাজির হন রাজ পরিবারের সব সদস্য। সেখানে পুজোপাঠে দেবীকে স্নান করানো হয়। তারপর শোভাযাত্রা সহকারে সেই পট রাজ পুরোহিতরা নিয়ে আসেন মৃন্ময়ী মন্দির চত্বরে। মন্দির চত্বরে বড় ঠাকুরানির প্রবেশের সময় মাধব সায়রের পাড় থেকে তিনটি তোপধ্বনি করা হয়। এই তোপের পর পট রাখা হয় মন্দিরের সামনে থাকা একটি বেদীতে। সেখানে চলে পুজোপাঠ। রাজ পরিবারের সদস্যেরা কুলদেবীকে বরণ করেন। পান পাতায় পা রেখে দেবী প্রবেশ করেন মন্দিরে। এই সময় আরও তিনটি তোপধ্বনি করা হয় মাধবসায়রের পাড়েই।

রাজ পুরোহিত সোমনাথ মুখোপাধ্যায় জানান যে, দেবী মৃন্ময়ীর পুজো পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা। মল্লরাজ পরিবারের স্বতন্ত্র বলীনারায়ণী পুঁথি অনুসারে এই পুজো হয়। সুপ্রাচীন নিয়ম মেনে কৃষ্ণা নবমীতে মন্দিরে আসেন বড় ঠাকুরানি অর্থাৎ মহাকালী। মানচতুর্থীর দিন একই ভাবে মন্দিরে আসেন মেজো ঠাকুরানি অর্থাৎ মহাসরস্বতী এবং ষষ্ঠীর দিন মন্দিরে আসেন ছোট ঠাকুরানি অর্থাৎ মহালক্ষ্মী। অষ্টমী এবং নবমীর মধ্যরাতে মন্দিরে পুজো হয় মহামারী বা খচ্চরবাহিনীর। মহামারী থেকে প্রজাদের বাঁচাতেই এই পুজোর প্রচলন করা হয় বলে কথিত আছে। অতীতে শাক্ত মতে এই পুজো হত। হত নরবলিও। কিন্তু শ্রীনিবাস আচার্যের সান্নিধ্যে এসে মল্ল রাজ পরিবার বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর থেকেই বলি বন্ধ হয়ে যায়। শব্দকে ব্রহ্মজ্ঞান করে তোপধ্বনির প্রচলন করা হয়।

এই প্রেক্ষিতে উল্লেখ্য, এক হাজার বছর আগে মল্লরাজাদের রাজধানী ছিল জয়পুরের প্রদ্যুম্নপুর গ্রামে। কথিত আছে মল্লরাজ জগৎমল্ল একবার শিকারে বেরিয়ে পথ ভুল করে চলে আসেন বিষ্ণুপুরে। সেখানে জঙ্গলের মধ্যে একটি বটগাছের তলায় তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। তখন দৈব নির্দেশ পান। সেই নির্দেশে ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ওই বটগাছের তলায় দেবী মৃন্ময়ী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী কালে তিনি মল্ল রাজধানী প্রদ্যুম্নপুর থেকে সরিয়ে নিয়ে আসেন বিষ্ণুপুরে। সেই সময় থেকেই শুরু হয় দেবীর পুজো। এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিষ্ণুপুরের মানুষের আবেগ।

রাজ পরিবারের সদস্য জ্যোতিপ্রসাদ সিংহঠাকুর জানান, এই পুজোর নিয়ম-নীতি প্রথম দিন থেকে প্রায় একই রকম রয়েছে। অতিতে মৃন্ময়ীর তোপধ্বনি শুনে গোটা মল্ল রাজত্ব, এমনকি, গোটা রাঢ়বঙ্গে পুজো শুরু হত। এখন সরকারি নিষেধ মেনে আগের মতো জোরে তোপধ্বনি হয় না। মল্ল রাজাদের অধীনস্থ অনেক জমিদারই এদিন থেকে দুর্গা পুজো শুরু করেছিলেন। জেলার বিভিন্ন জায়গায় আজও পূজা হয়ে আসছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *