Education, Bengali textbook, জাতীয় শিক্ষানীতির ফসল, কৃতীদের তদারকিতে উঁচু মানের বাংলা পাঠ্যপুস্তক

অশোক সেনগুপ্ত, আমাদের ভারত, ৩০ সেপ্টেম্বর:
আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু থেকে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা থেকে প্রফুল্ল চন্দ্র মহালানবীশ— যুগ যুগ ধরে এঁদের বাংলায় লেখা বিজ্ঞানের বই পড়ে বিশ্বজয় করেছেন বঙ্গসন্তানরা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মত যশস্বীরাও মাতৃভাষায় পাঠ্যবইয়ের স্বাদ মিটিয়েছেন যুগ যুগ ধরে। হারিয়ে যেতে বসা সোনালী সেই দিন ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়েছে বাংলা ভাষা সংবর্ধন সমিতি (বিবিএসএস)। কেন্দ্রীয় প্রকল্প অনুসারে উচ্চশিক্ষায় আঞ্চলিক কিছু ভাষার মতো বাংলাতেও ভালো মানের পর্যাপ্ত পাঠ্যপুস্তক লেখার জন্য এক ছাতার নীচে সমবেত হয়েছেন কিছু অত্যন্ত যশস্বী মানুষ।

বিবিএসএস-এর নোডাল অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ এডুকেশনাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিট্যুট (আরকেএমভেরি)-এর উপাচার্য স্বামী সর্বোত্তমানন্দকে। বিষয়টি নিয়ে দু’দিনের এক প্রারম্ভিক কর্মশালার আয়োজন করা হচ্ছে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে। বিবিএসএস-এর হয়ে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা নিচ্ছেন সাহিত্য অ্যাকাডেমির বাংলা উপদেষ্টা বোর্ডের প্রাক্তন আহ্বায়ক, ভারতীয় ভাষা পরিষদের প্রাক্তন সভাপতি, বিশ্বভারতীর প্রকাশনা বিভাগের প্রাক্তন পরিচালক ডঃ রামকুমার মুখোপাধ্যায়।

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের সম্পাদক স্বামী শাস্ত্রজ্ঞানানন্দ জানান, স্বামী সর্বোত্তমানন্দর জ্ঞান ও প্রতিষ্ঠা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। যুগ যুগ ধরে পড়ুয়ারা নত হয়ে আছেন তাঁর প্রতি। এ ছাড়া, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখনী এক অর্থে অনন্য এবং অসাধারণ। সাহিত্য অ্যাকাডেমির হয়ে প্রচুর বই বাংলায় অনুবাদ করিয়েছেন। আবার অনেক কালজয়ী বাংলা বই অনুবাদের মাধ্যমে অন্য প্রদেশের ভাষাভাষিদের পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। এ ছাড়াও এই কর্মযজ্ঞে সামিল হয়েছেন জাতীয় স্তরে অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত ও প্রকৃতই কৃতী কিছু শিক্ষাবিদ।

কর্মশালার সূত্রধর তমাল ব্রহ্মচারী জানান, “জয়েন্ট এন্ট্রান্সের সর্বভারতীয় পরীক্ষায় ঈর্ষণীয় ফল দেখিয়েছিলেন মহারাজ। ১৯৯৫-তে আইআইটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সের পিএইচডি করেন। তাঁর কৃতি ছাত্ররা ছড়িয়ে আছেন বিশ্বময়। আগে আরকেএমভেরি-র নিবন্ধক ও সহ উপাচার্য ছিলেন। তিনি এতোটাই পড়াশোনা অন্তপ্রাণ যে এখনও নিয়মিত ক্লাস নেন। প্রায়শই তা নেন বাংলা ভাষায়। তাঁকেই করা হয়েছে বাংলা ভাষা সংবর্ধন সমিতির পুরোধা।”

কর্মশালার প্রথম দিন প্রথম ভাগে ‘মূলত বাংলা ভাষায় পাঠ্যপুস্তক লিখন— নীতি-নির্ধারণ’ ও সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় নিয়ে বলেন স্বামী সর্বোত্তমানন্দ, রামকুমার মুখোপাধ্যায়, বেলুড় মঠের ব্রহ্মচারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ, তথা রামকৃষ্ণ মিশন শিক্ষণ মন্দিরের প্রাক্তন অধ্যক্ষ স্বামী তত্ত্বসারানন্দ, হেরিটেজ ইন্সটিট্যুট অফ টেকনোলজির অধ্যক্ষ তথা প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ বাসব চৌধুরী প্রমুখ।

রামকৃষ্ণ মিশন শিল্পমন্দিরের প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডক্টরেট, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সদস্য (২০১১—’১৯), রাজ্যের স্কুল শিক্ষা কমিটির প্রাক্তন সদস্য স্বামী তত্ত্বসারানন্দ এ দিন তাঁর ভাষণে বলেন, এতকাল কি আমাদের দেশে নিজস্ব ভাষায় পাঠ্যপুস্তক ছিল না? ছিল। তবে, নয়া জাতীয় শিক্ষানীতিতে ভারতের নিজস্ব ভাষায় পাঠ্যপুস্তক লেখার এই উদ্যোগের বিশেষ প্রেক্ষিত আছে। হৃদয়ঙ্গমের জন্য মাতৃভাষা অতুলনীয়।

অনুবাদের পাঠ্যপুস্তক গ্রহণযোগ্য হয় না। এ প্রসঙ্গে স্বামী তত্ত্বসারানন্দর অভিমত, স্বামীজীর লেখা তাঁর শিষ্য শুদ্ধানন্দজী অনুবাদ করেছেন। কিন্তু মনে হয় বাংলাটা অনেক বেশি প্রাণের ভাষা। রবীন্দ্রনাথ, আচার্য জগদীশচন্দ্র বোসের লেখার ক্ষেত্রেও এটা সত্য। ‘খেয়া’-র কবিতা রবীন্দ্রনাথ নিজেই অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু সেটা কালোত্তীর্ণ হতে পারেনি। পাঠ্যপুস্তক লেখার সময় ভাবার ভাষা, কথা বলার ভাষা,পড়ানো ভাষা, বোঝার ভাষা— এ সবটাই মাথায় রাখা দরকার।

পাঠ্যপুস্তক লেখার সময় গুগুল অনুবাদকের সহায়তা বিপদ ডেকে আনার পক্ষে যথেষ্ঠ বলে মন্তব্য করেন স্বামী তত্ত্বসারানন্দ। তাঁর মতে, শাস্ত্রের ঘরানা অনুসরণ করা যেতে পারে। আগে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের যে সব বই লেখা হয়েছে, সেগুলো থেকেও পথনির্দেশ পাওয়া সম্ভব। স্বামীজী বলেছিলেন, যে শিক্ষক ছাত্রের মন দিয়ে ভাবেন, কান দিয়ে শোনেন, চোখ দিয়ে দেখেন, তিনিই প্রকৃত শিক্ষক। পাঠ্যপুস্তককেও তেমনই পড়ুয়াবান্ধব হতে হবে।

স্বামী তত্ত্বসারানন্দর কথায়, “চ্যালেঞ্জের বাংলা করা হয় প্রতিস্পর্ধা। এটা কি পড়ুয়া গ্রহণ করবে? মনে রাখতে হবে, কিছু ক্ষেত্রে জোর করে ইংরেজি শব্দের বাংলায় করা যায় না। ইউজিসি এ ব্যাপারে কতটা নমনীয় সেটাও বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকের লেখকদের মাথায় রাখতে হবে। বাংলা বইয়ের পরিভাষায় যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। প্রয়োজনে সে ব্যাপারে ইউজিসি-র ওয়েবসাইটের স্বীকৃত লিখন অথবা সেই বিভাগে দায়িত্বপ্রাপ্ত বাঙালিদের সহায়তা নিতে হবে।” এই কথার খেই ধরে কর্মশালার সূত্রধর তমাল ব্রহ্মচারী বলেন, কর্মশালার আগে ওরিয়েন্টেশন কথাটার বাংলা অভিযোজন করলে পাঠক নিতে পারবে? আসলে ইংরেজি শব্দ এত বেশি পরিচিত হয়ে গিয়েছে, বাংলায় লিখলে পাঠ্যপুস্তক লেখকদের যথেষ্ঠ সচেতনভাবে সেগুলো চয়ন করতে হবে।

কল্যাণভারতী ট্রাস্টের সিনিয়র ডিরেক্টর ডঃ বাসব চৌধুরী বাংলা ভাষাচর্চার ধারা সংক্ষেপে উল্লেখ করে স্বীকার করেন, ইতিহাসগত নানা বাস্তবতায় সেভাবে বাংলা বিকশিত হয়নি। এটা বাংলায় উঁচু মানের পাঠ্যপুস্তক লেখার একটা অন্যতম বাধা। তবে, যথেষ্ঠ নিষ্ঠা এবং বাস্তব ভাবনার অভাবও এর অন্যতম কারণ। আমি একজনকে জানি ৩৬টি পাঠ্যপুস্তক লিখেছেন। অন্য ১০ জনের গবেষনাপত্রের আগে নিজের একটা গবেষনাপত্র যুক্ত করে তাঁর নামে সেই সংকলন কেউ প্রকাশ করলে সেটার কোনও অর্থ হয়? বাংলায় কেউ পাঠ্যপুস্তক লিখলে তাঁকে যথেষ্ঠ যত্নবান হতে হবে। পড়ুয়াদের মনোভাব বুঝতে হবে। সতীনাথ ভাদুড়ি দোকানে বসতেন। বিক্রির ফাঁকে ক্রমাগত বই পড়তেন। এই যে পড়ার মধ্যে আনন্দ, রস আস্বাদনের আবশ্যিকতা, সেটাও তো পাঠ্যপুস্তকে যথেষ্ঠ মাত্রায় রাখতে হবে!

বাসববাবুর মতে, বাংলায় পাঠ্যপুস্তক লেখার সময় আমাদের মানসিকতারও বদল প্রয়োজন। বাঙালি প্রশ্নকর্তা, বাঙালি প্রার্থীকে সাক্ষাৎকারের শুরুতে কখনও বলবেন না, “নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন।” বদলে ওই কথা বলবেন ইংরেজিতে। মনে পড়ে ডঃ অশোক মিত্রর বাংলা বক্তৃতা। কী অসাধারণ প্রজ্ঞা, কী অবাক করা শব্দচয়ন! শ্রোতার এই যে মুগ্ধতা, তার উপযোগিতা বাংলায় পাঠ্যপুস্তক লেখার সময় ভাবতে হবে পড়ুয়ার কথা ভেবে। উপস্থিত গুণীজনের উদ্দেশে বাসববাবুর নিবেদন, কলেজে-পড়ুয়ার কাঁচা মনের কথা ভেবে পাঠ্যপুস্তক লিখুন! যেটা তাঁরা আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতে পারবেন। এমন একটা পাঠ্যপুস্তক লিখবেন, যেটা পড়ে গ্রামের একজন সাধারণ পড়ুয়া স্নাতক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।

কর্মশালার দ্বিতীয় ভাগে আলোচনায় অংশ নেন আরকেএমভেরি-র পরীক্ষাসমূহের নিয়ামক স্বামী শাস্ত্রবিদ্যানন্দ, কর্মশালার প্রধান সমন্বয়কারী আরকেএমভেরি-র তমাল ব্রহ্মচারী, স্বামী শাস্ত্রজ্ঞানানন্দ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *