ড. রাজলক্ষ্মী বসু
আমাদের ভারত, ৭ জুন: কেরালায় হস্তিনীর নির্মম মৃত্যু পরিবেশ দিবসের উপকেন্ঠ ঘটল। পরিবেশ দিবসে সবাই যখন গাছ লাগানোর কথা বলছেন তখন এ তথ্যও উঠে আসে যে ভারতের ৭৮% হাতি অসংরক্ষিত বনে বাস করে। তারা অরণ্য সংকোচনের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছে। খাদ্যের সন্ধানেই বাধ্য হয়ে বন থেকে সড়কে কখনও বা গ্রামে এমনকি অধিক বসতিযুক্ত লোকালয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে। পরিবেশ তাদের উপর যে অত্যাচার অনাচার করছে তার দায় তো মানুষেরই। সে সব কথা যদিও পুরোনো কাসুন্দি- আমরা কতটা পাপ আর অবিবেচকের মতো কাজ করছি তা সবাই জানি। বইতেও তা বিস্তর মুখস্থ করেছি। প্রকৃতির সবটাই যেন taken for granted ভাবি আমরা, আর এটাই আমাদের মস্ত বড় ভুল।
আমাদের জন্য কি এই হস্তিকুলের ব্যবহারিক বা মানুষের প্রতি বিশ্বাসের দিকটাই তাহলে বদলাচ্ছে? প্রাণী- মানুষের সহাবস্থানের সহানুভূতি যেহেতু এক বিষম সম্পর্ক তাই হাতিও এনেছে নানান অভিযোজন। গবেষণায় উঠে এসেছে সেসব চাঞ্চল্যকর বিষয়। হাতিরাও আমাদের মতো মা-বাবা-কাকা-ভাই -বোন নিয়ে সমাজবদ্ধ ভাবে থাকে। দক্ষিণ ভারতের পুরুষ হাতির মধ্যে বিশেষ করে তাজা রক্তের যারা তারা আগে একাই বিচরণ করত। “Scientific Report” এর সমীক্ষা বলছে, মানুষের ল্যান্ডস্কেপে পেটের দায়ে আসার তাগিদে তরতাজা পুরুষ হাতিরা এখন আর একা প্রায় ঘোরেই না। সাথে রাখছে অভিজ্ঞ পুরুষ হাতিকে। কারণ তারাই পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে। জনবসতি ঘেঁষা ধানক্ষেত ছাড়াও অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ঘাসের জমিতেও বড়ো অভিজ্ঞ হাতি অন্যদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে ইদানিং।
কর্ণাটকের কান্নারঘাট ন্যাশনাল পার্কের চত্তরেও হাতি চরিত্র পর্যবেক্ষণ করে পশু বিশেষজ্ঞ শ্রীশান্ত শ্রীনিবাসন বলেছেন, মানুষের অত্যাচারে হাতি ক্রমশঃ গ্রামে অনুপ্রবেশ কমাচ্ছে। হাতি ক্রমশঃ বড় ঘাস জমি এবং সুযোগ পেলে ধান জমির দিকেই অধিক আকৃষ্ট। অদ্ভুত ভাবে এই সব জমিতে খাদ্যের সন্ধানে কেবলমাত্র পুরুষ হাতিরাই আসছে। এই পরীক্ষাটি প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার অঞ্চলে সম্পন্ন করা হয়। সে অঞ্চলে সংরক্ষতি বন এবং মানুষের বসবাস দুইই আছে। কান্নারঘাট ন্যাশনাল পার্ক, কাবেরী এবং উত্তর কাবেরী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের সংলগ্ন কৃষি ও কৃষিযোগ্য ঘাস জমিতে দীর্ঘদিন চলে গজ পরিক্রমা পর্যবেক্ষণ। গত ২০১৬ র ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ২০১৭ র মধ্যে মোট ২০,১২৪ টি ফটো ও ভিডিও সংগ্রহের পর দেখা গেল হাতিরা তিনরকম দল বা খাদ্য সংগ্রহের বিন্যাস গঠন করেছে।
এক: মিক্সড সেক্স, দুই: পুরুষ দল, এবং তিন: একাকী পুরুষ। বয়সের শ্রেণিবিন্যাস এবং এই তিনটি মডেল সরাসরি ভাবে যুক্ত। দশ বছরের কম পুরুষ হাতি সর্বদাই মিক্সড সেক্স গ্রুপে থাকছে। যতক্ষণ না পর্যন্ত বয়ঃসন্ধি অতিক্রম হচ্ছে, হাতির দল কোনও পুরুষ হাতিকে আর একা থাকার অনুমতি দিচ্ছে না। সবই হচ্ছে আমাদের উৎপাতের জন্য। সুরক্ষার বেড়া ওরা ওদের মতো করে বানাচ্ছে। পুরুষ হাতির দলে বারোটি হাতিই সর্বাপেক্ষা পর্যবেক্ষিত হচ্ছে। এই বারো সংখ্যার রহস্য এখনো উন্মোচিত হয়নি।
গত এক দশকের পূর্বে হাতির আচরনে বা খাদ্য সংগ্রহের উদ্দেশে এমন কোনো মডেল দেখা যায়নি। এই পুরুষ হাতির দলগুলি আবার সপ্তাহখানেক স্হায়ী হচ্ছে। আবার নতুন দল গঠনের পালা। অর্থাৎ পারমুটেশন কম্বিনেশন কৌশলে এখন চলছে দল গঠন। এই ধরনের পদ্ধতিকে বলে সোস্যাল বাফারিং। এর ফলে যেমন ক্ষতির সম্ভাবনা কিছুটা কমাতে পারে তেমনই হাতির দলবল পায় অধিক মনোবল। ল্যান্ডস্কেপ কি কি ভাবে ব্যবহার করা যায় তা সত্যিই এই মুহূর্তে হাতির থেকে শেখার।
এই ধরনের হাতির দলের মডেল শ্রীলঙ্কাতেও লক্ষ্য করা গেছে। শ্রীলঙ্কার সেন্টার ফর কনজারভেশন এন্ড রিসার্চ এই ধরনের মডেলের পর্যবেক্ষণের দ্বারা হাতিকেই শ্রেষ্ঠ কৌশলগত অভিযোজনশীল প্রাণী বলে চিহ্নিত করছে। শ্রীলঙ্কায় আশ্চর্যজনক ভাবে দেখা গেছে হাতি এবং মহিষ পাল একই ঘাসজমিতে বিচরণরত। হাতির কথা হবে আর ঝাড়খন্ডের নাম কলমে উঁকি দেবে না, তা কি করে হয়! নির্মলা টুপুনের কথাও মনে না করা অন্যায়। মাত্র ১৩-১৪ বছরের কিশোরী। সেই দুঃসাহসিনী পাগলা হাতিকে বশ মানাতো। অদ্ভুত ভাবে বুঝতো তাদের গতিবিধি। নির্মলা কোনও প্রাণীবিশারদ বা কোনও ডিগ্রিধারী নয়, তথাপিও তার প্রচেষ্টায় সাড়া দিয়ে হাতিরা গ্রামে ঢুকে উৎপাত অনেক কমায়। কিন্তু ২০১৫ র জুন মাসের পর থেকে হঠাৎ সেই হাতিদের চরিত্র বদলে যায়। তারা আর নির্মলার কথা শোনেনি। উল্টে তার বাবাকেই মেরে ফেলে। ওই বছরই রৌরকেল্লার সড়কে এগারোটা পুরুষ হাতি কিছুর পরোয়া না করে হেঁটে বেড়ায়। এমনই অস্বাভাবিক আচরন তারা করে যে ট্রাক বোঝাই কাঁঠাল ভেট দিতে হয় তাদের মন রাখতে। সেদিন ওই ঘটনাকে moving zoo বলে ঠাট্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ঠাট্টার বিষয় যে এগুলো নয়, এ গভীর সঙ্কটের বিষয়। সুন্দরগড় জেলায় তো আগে হাতিই দেখা যেত না। এখন হাতির পাল সেখানে। কেওনঝড়ের জঙ্গল থেকে হয়তো এরা গজগমনে এসেছে। এই অঞ্চলের কৌরমুন্ডা জঙ্গলে প্রথম অযাচিত হাতির পাল দেখা যায়। এ জঙ্গল তো খুব ঘন নয়, তাহলে? দেখা গেছে এমন কিছু গাছপাতা ওই বনে আছে যাতে হাতির পুষ্টি বেশ কিছুটা মেলে। কিন্তু এভাবে নতুন একটা গজিয়ে ওঠা জঙ্গলের হদিশ ওদের কেই বা দিল! হাতি কি তবে এক ভ্রাম্যমান যাযাবর প্রজাতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে? হাতি যে আর আলো, আগুনে ভীত নয়। তার প্রমান মিলেছে রৌরকেল্লার ৪০ কিলোমিটার দূরে। বন দপ্তরের কর্মীরাও হাতির দলকে রুদ্ধ করতে পারেনি। এই মুহূর্তে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শালবন সারেঙ্গায়, সিংভূম জেলা। ৮০০ বর্গকিলোমিটার এই বনেও হাতিরা নিশ্চিন্ত নয়। এক অষ্টাংশ বন লিজে আছে লৌহ খনির জন্য। সেখানেও হাতি তাদের চরিত্র বদলাচ্ছে। প্রতিনিয়ত হাতির চরিত্র যেভাবে বদল হচ্ছে তাতে তার বাধা ধরা কোনও নিয়ম বা মডেল তৈরি করা যাচ্ছে না। গজগমন তাই অব্যাহত। আমরা এতো উন্নত হয়েও ওদের গতিবিধির রহস্য বুঝতে অক্ষম।