অশোক সেনগুপ্ত, আমাদের ভারত, ৩ জানুয়ারি: অল্প ক’দিনের জন্য উত্তরপ্রদেশ ঘুরে এলাম। ছিলাম যোগী আদিত্যনাথের ‘নিজের শহর’ গোরক্ষপুরে। শহরটার বিভিন্ন জায়গা এবেলা ওবেলা ঘুরেছি। পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের কারও কারও মুখে দুই রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গকে এগিয়ে রাখার চেষ্টা এবং বুলডোজার যোগীর সমালোচনা শুনি। কিন্তু…।
প্রথমেই বলি, অতীত, ঐতিহ্য, স্থানীয় সংস্কৃতি প্রভৃতির নিরিখে প্রতিটি শহরের নিজস্ব কিছু চরিত্র থাকে। তুলনা সেভাবে করা যায় না। গোরক্ষপুর মূল শহরটা অনেক পুরনো। পথঘাট, বাড়িঘরেও তার ছাপ। তার মধ্যেও কিছু রাস্তা ভেঙ্গে একটু চওড়া হয়েছে। তবে, ট্রাফিক সিস্টেম কলকাতায় অনেক ভালো। গোরক্ষপুরে খুব কম মোড়েই ট্রাফিক পুলিশ চোখে পড়ল। চালকরাই পরম মুন্সিয়ানার সঙ্গে দুর্ঘটনা এড়িয়ে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করে।
পুরনো শহরে পুরআইন সেভাবে নেই বলেই মনে হলো। অন্তত নির্মাণের ক্ষেত্রে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও সেকেলে। বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে নামী ব্যক্তিত্বদের মূর্তি, যেমন সর্দার প্যাটেল, সুভাষচন্দ্র বসু, ভগৎ সিং। বন্ধুপুত্র শচীনের সওয়ারি হয়ে যেতে গিয়ে ওকে থামিয়ে এরকম একটা মোড় থেকে নেতাজির মূর্তির ছবি তুলে নিলাম।
গোরক্ষপুর থেকে অযোধ্যা প্রায় ১৩০ কিমি পথ খুবই প্রশস্ত। মসৃণ রাস্তার ওপর দিয়ে সাঁ সাঁ করে গাড়ি বেড়িয়ে গেল। সঙ্গী অরবিন্দ দুবে বললেন, “অশোকদা আগে রাস্তা খুব খারাপ ছিল। যা হয়েছে সবই যোগীজীর জন্য হয়েছে।” পশ্চিমী দেশগুলোর রাস্তা বাদ দিলাম, মনে পড়ছিল ব্যাঙ্কক থেকে পাট্টায়ার সুন্দর রাস্তার কথা। সেই সঙ্গে মনে পড়ছিল কলকাতা থেকে সম্প্রতি ডায়মন্ডহারবার যেতে গিয়ে আমতলা-সহ বিভিন্ন জায়গায় যানজটে প্রবল হোঁচট খাওয়ার কথা।
মন ভরে গেল গোরক্ষনাথের মঠ দেখে। সত্যি, না দেখলে কী হারাতাম, অনুভব করতে পারতাম না। পশ্চিমবঙ্গেও বেলুড়মঠ, মায়াপুরে ইস্কন মন ভালো করে দেয়। যে অনুভবটা কালীঘাটে একেবারেই আসে না দৃশ্যদূষণে। খরচ করে স্কাইওয়াক হল। কিন্তু নিচে মনে হচ্ছে বস্তি। বাইরের অনেকে এসে কালীঘাট দর্শনে যান। আমি মনে করি ভক্তির সঙ্গে পারিপার্শ্বিক সৌন্দর্যায়নের সম্পর্কটা নিবিড়। বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে কালীঘাট সংস্কার হলো। কিন্তু বাসরাস্তা থেকে মন্দির পর্যন্ত হয়ে উঠলো নরককুন্ড। অথচ, মন ভরে গেল পুরনো গোরক্ষপুরে কোতোয়ালি রোডে চিত্রকূট মন্দির দেখে।
অযোধ্যার মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটনের সময় তার প্রচার নিয়ে অনেকের গাত্রদাহ হচ্ছিল। তুলনায় নিয়ে আসা হচ্ছিল দিঘার প্রস্তাবিত মন্দির। কিন্তু অযোধ্যায় গিয়ে দেখলাম, কী বিপুল কর্মযজ্ঞ হয়েছে এবং হচ্ছে। ‘আমি’ ‘আমি’ করলে হবে না। লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়। গোটা চত্বর নিপুনভাবে সাজাতে বুলডোজারের প্রয়োজন হয়েছে। এর জন্য দাপট দরকার।
গোরক্ষপুর থেকে চৌড়িচৌড়া যেতে প্রায় এক ঘন্টা লাগল। মেহদিপুর, কুরাঘাট, রানিদীহা, রামনগর, জঙ্গল সিকরি, করজাহান, দেওরিয়া রোড, ফুটাহাওয়া ইনার— পুরোটা প্রশস্ত রাস্তা। লক্ষ্য করলাম, রাস্তা প্রশস্ত করতে দু’পাশে অনেক বাড়ির সম্মুখভাগ ভাঙ্গা হয়েছে। অথচ, কেন্দ্রীয় অর্থ বরাদ্দ এবং দিল্লির বারংবার আর্জি সত্বেও যশোর রোড প্রশস্ত করার কাজ আটকে গিয়েছে। নেপথ্যে নানা অজুহাত।
মাননীয়া অনেকদিন ধরেই সরকারি জমি দখলমুক্ত করার কথা বলছেন। কিন্তু ক’টা জায়গা থেকে দখলদার উচ্ছেদ হয়েছে জানি না। বরং, মাছির মতো বেড়েই চলেছে। আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, দখলমুক্ত, প্রশস্ত রাস্তা, জনপদ একমাত্র তিনিই উপহার দিতে পারতেন। কলকাতা সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করলেই আমরা হইহই করে উঠি। এসপ্লানেড চত্বরের হকার, বিশেষত রেল, বন্দর—এদের এলাকা থেকে দখলদার উচ্ছেদ করতে গেলেই পিছু হঠতে হয় নেতিবাচক রাজনীতির অস্ত্রে। আদালতের নির্দেশিকা থাকলেও।
বুলডোজার হ্যাঁ বা না-এর বিতর্কে আমি হ্যাঁ-তেই সায় দেবো। তবে, মাননীয়া আন্তরিকভাবে চাইলে বুলডোজার ছাড়াও পারবেন মন ভালো করা জনপদ উপহার দিতে। তিনি চাইলে পারেন না, এমন কাজ নেই। কেবল দৃষ্টিভঙ্গী ইতিবাচক হওয়া দরকার। অযোধ্যা প্রকৃতই হয়ে উঠছে আন্তর্জাতিক নগরী। নেপথ্যে মূলত সুদূরপ্রসারী ভাবনা ও পরিকল্পনা এবং সদিচ্ছা।
ছবিতে লেখায় উল্লেখিত রাস্তার মোড়ে সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তি, প্রশস্ত রাস্তা এবং চিত্রকূট মন্দিরের ছবি।