Dark Tourism, Medinipur, মেদিনীপুর কলেজে তিন দিনের আন্তর্জাতিক ডার্ক ট্যুরিজম সম্মেলন

পার্থ খাঁড়া, আমাদের ভারত, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৪ সেপ্টেম্বর: মেদিনীপুর কলেজ (স্বশাসিত) এর ঐতিহ্যপূর্ণ বিবেকানন্দ হলে “Exploring the Murky Depths: A Conference on Dark Tourism in Modern Societies where Historical Narratives Encounter Geographical Landscapes” শীর্ষক তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আজ সূচনা হলো। ভারতীয় সামাজিক বিজ্ঞান ও গবেষণা পরিষদ (ICSSR)-এর অর্থানুকূল্যে আয়োজিত এই সম্মেলনটি, সারা বিশ্ব থেকে প্রায় ১০০ জন শিক্ষাবিদ এবং গবেষককে আকৃষ্ট করেছে, যারা ডার্ক ট্যুরিজমের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা নিয়ে আলোচনা করছেন। সম্মেলনের সূচনা হয় প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে।

সম্মেলনের আহ্বায়ক ডঃ মণিশ্রী মন্ডল তার উষ্ণ স্বাগত ভাষণে বলেন, ডার্ক ট্যুরিজমের ক্ষেত্রটি ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলির সাথে ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটের সংযোগ ঘটিয়ে মৃত্যু, ট্র্যাজেডি এবং বিপর্যয়ের সাথে সম্পর্কিত সমস্ত স্থানগুলিকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝার সুযোগ করে দেয়। তিনি পর্যটন গবেষণায় ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা ডার্ক ট্যুরিজম বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক শ্রী সত্যরঞ্জন ঘোষ তার উদ্বোধনী ভাষণে সম্মেলনের উদ্দেশ্য তুলে ধরেন। তিনি ডার্ক ট্যুরিজমের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে বলেন, এই ক্ষেত্রটি পর্যটকদের ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডিগুলির সাথে এমনভাবে সংযোগ ঘটাতে সাহায্য করে, যা শিক্ষণ ও প্রতিফলনের জন্য সুযোগ তৈরি করে। তিনি বলেন, “ডার্ক ট্যুরিজম আমাদের ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়গুলোকে নতুন আলোকে দেখতে শেখায়, এবং এই বর্ণনাগুলিকে সংবেদনশীলতার সাথে পরিচালনা করাই আমাদের দায়িত্ব।” এমন আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করার জন্য তিনি উদ্যোক্তাদের সাধুবাদ জানান।

সম্মেলনে ভাষণ দেন আরও দুই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের প্রাক্তন অধ্যাপক ও কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি ডঃ অভিজিৎ চক্রবর্তী তার বক্তব্যে ডার্ক ট্যুরিজমের নৈতিক দিকগুলির উপর জোর দেন। তিনি বলেন, যদিও এই ধরনের পর্যটন ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডিগুলিকে সামনে নিয়ে আসে, তবে তা মৃত্যুর বাণিজ্যিকীকরণ সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে। “স্মৃতিচারণ ও শোষণের মধ্যে এক সূক্ষ্ম সীমা রয়েছে, এবং এটাই আমাদের ভাবনার মূল বিষয় হওয়া উচিত।”

মহাত্মা গান্ধী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডঃ বিভরাজ ভূষণ পারিদা তার বক্তব্যে ডার্ক ট্যুরিজমের মাধ্যমে সংস্কৃতির মধ্যে বোঝাপড়া বৃদ্ধি করার কথা উল্লেখ করেন, যেখানে ঐতিহাসিক ঘটনা সমসাময়িক সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। তিনি উপস্থিত সকলকে মানবিক যন্ত্রণার সাক্ষী স্থানগুলি পরিদর্শনের সময় যে সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা প্রয়োজন, তা নিয়ে ভাবনার আহ্বান জানান।

বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডঃ সুশান্ত কুমার চক্রবর্তী তার উৎসাহমূলক বার্তা প্রেরণ করেন। তিনি সরাসরি উপস্থিত থাকতে না পারলেও, তার বার্তায় তিনি এই বিষয়টিতে প্রাতিষ্ঠানিক অনুসন্ধানের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি ডার্ক ট্যুরিজমকে “ইতিহাসের গভীর স্তরগুলি বোঝার একটি মাধ্যম” হিসেবে উল্লেখ করেন এবং আশা প্রকাশ করেন যে, আগামী তিন দিনের আলোচনা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিন্তাধারা উন্মোচন করবে।

উদ্বোধনী অধিবেশনের মূল আকর্ষণ ছিল মুগলা সিটকি ককমান বিশ্ববিদ্যালয়, তুরস্কের ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট বিভাগের গবেষক ডঃ এমিনে ইলমাজের সূচক বক্তব্য। তার মনোমুগ্ধকর এবং গভীর চিন্তাশীল বক্তব্যে তিনি বিশ্বব্যাপী ডার্ক ট্যুরিজমের উত্থান এবং যুদ্ধ স্মৃতিসৌধ, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এবং বিপর্যয়ের স্থানগুলির মতো স্থানগুলি কীভাবে জনসাধারণের স্মৃতিকে গঠন করে তা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি শিক্ষার উদ্দেশ্যে এই স্থানগুলির গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে বলেন, “আমাদের এই স্থানগুলিকে সম্মানের সাথে দেখতে হবে, শিখতে হবে, কিন্তু কখনই সেগুলিকে উত্তেজক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়।”

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় সরকারের আর্থ সায়েন্স মন্ত্রকের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী ডঃ শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়, দিল্লীর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ডঃ নিমিত চৌধুরী, এবং বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ডঃ দিলীপ কুমার দাশ। উপস্থিত ছিলেন মেদিনীপুর কলেজের বিভিন্ন বিভাগের অধ্যাপক, অধ্যাপিকারা। হাইব্রিড মোডে অনুষ্ঠিত হওয়া এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশ নেন আরো বহু বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। উদ্বোধন হয় আলোচনা চক্রের প্রোসিডিংস পুস্তিকা।

পরবর্তী দুই দিন ধরে সম্মেলনে বিভিন্ন প্যানেল আলোচনা এবং গবেষণাপত্র উপস্থাপনা করা হবে। এর মধ্যে থাকছে ডার্ক ট্যুরিজমের নৈতিকতা, মিডিয়ার প্রভাব, এবং ট্র্যাজেডির স্মৃতিচারণের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব। ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান এবং পর্যটন গবেষণার বিভিন্ন শাখার পণ্ডিতেরা তাদের গবেষণা উপস্থাপন করবেন। প্রায় ১০০ জন অংশগ্রহণকারী নিয়ে এই সম্মেলন একটি অনন্য আন্তঃবিষয়ক আলোচনার ক্ষেত্র যেখানে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমসাময়িক পর্যটন, নৈতিকতা ও স্মৃতির প্রশ্নগুলি গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হবে। তিনদিন ব্যাপী এই সম্মেলন চলবে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *