সাথী দাস, পুরুলিয়া, ২৯ নভেম্বর: ৪৫ বছর আগের ছাত্র জীবনে সত্যজিৎ রায়ের ‘সন্দেশ ‘ পত্রিকায় শিশুদের জন্য লিখেছিলেন পুরুলিয়ার বিশিষ্ট ঝুমুর শিল্পী, কবি ও সাহিত্যিক সুনীল মাহাতো। সেই সব অতীতের স্মৃতি মনের মধ্যে থাকলেও তেমন কোনও প্রামান তাঁর কাছে ছিল না। সেই প্রামাণ্য দলিল অনুসন্ধানের মাধ্যমে সংগ্রহ করেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তথা জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত আলোক চিত্রী স্বরূপ দত্ত। তিনি সেই সব শিশু সাহিত্য বই আকারে করে সাহিত্যিক সুনীল মাহাতোর জন্মদিনে উপহার হিসেবে তুলে দিলেন।
প্রবাদ প্রতীম পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ শুরু হতে চলেছে। এই পরিস্থিতিতেই তাঁকে আজ এই ভাবে স্মরণ করলেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী স্বরূপ দত্ত।
পুরুলিয়া শহরের ডাক্তার ডাঙ্গার বাসিন্দা স্বরূপবাবু দীর্ঘদিন ধরে অঙ্কন এবং স্টিল ফোটোগ্রাফির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। পেয়েছেন বহু পুরস্কার। কাজ করেছেন বহু বিশিষ্ট চিত্র পরিচালকের সঙ্গে। পুরুলিয়া জেলার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই অনুসন্ধান চালাচ্ছেন তিনি। হীরক রাজার দেশে ছবিটির শ্যুটিং করার জন্য পুরুলিয়ায় টানা ছিলেন সত্যজিৎ রায়। এটিকেই তাঁর পুরুলিয়ার সঙ্গে যোগসূত্র ধরা হয়। তবে একটা বিষয় এখনও প্রকাশ পায়নি। অনামী সাহিত্যিকদের প্রতি তাঁর অনুপ্রেরণা। তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন বর্তমানে পুরুলিয়া জেলার অন্যতম কবি ও সাহিত্যিক সুনীল মাহাতো। তাঁকে সন্দেশ পত্রিকায় লেখার সুযোগ দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। তখন একেবারের তরুণ সুনীল মাহাতো। গ্রামে থাকেন। পরবর্তী কালে অবশ্য তিনি হয়ে যান সারা বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক ও কবি। তার লেখা প্রখ্যাত সেই গান “পিঁদাড়ে পলাশের বন” আজ মুখে মুখে ফেরে। এখনও পর্যন্ত কয়েকশ ঝুমুর এবং অনান্য কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন তিনি।
১৯৭৪ সালে সুনীলবাবু তখন একান্তই তরুণ। সেসময়ই তিনি ডাকে সন্দেশের ঠিকানায় “আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই” নামে লেখাটি কোনও প্রত্যাশা ছাড়াই পাঠিয়েছিলেন। হঠাত করেই একটি চিঠি চলে আসে সুনীলবাবুর ঠিকানায়। স্বয়ং সত্যজিৎ রায় সুনীলবাবুর লেখাটি সন্দেশ পত্রিকায় ছাপানোর কথা জানান। সেবছরই জুলাই মাসে সন্দেশের শ্রাবণ সংখ্যায় লেখা বার হয়। সাম্মানিক হিসেবে কুড়ি টাকাও পান সুনীলবাবু।
এরপর একে একে আরও লেখা বার হয় তার। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব চলে যায় বিস্মৃতির অতলে। সুনীল মাহাতো বি এস সি পাশ করার পর চলে যান কলকাতায়। সেখানে যোগেশ চন্দ্র চৌধুরী কলেজ থেকে এল এল বি পড়েন। এরপর চলে যান রাঁচিতে। সেখানে ট্রাইবাল এন্ড রিজিওনাল ল্যাঙ্গুয়েজেস বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। এরমধ্যেই গ্রাম ছেড়ে পুরুলিয়া শহরে বাস করতে শুরু করেন তিনি। একাধিকবার ঘর পাল্টাতে হয় তাঁকে। হারিয়ে যায় পুরনো কাগজপত্র। চিঠির বান্ডিল। সেই সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের লেখা মহার্ঘ্য চিঠি এবং সন্দেশের সেই সংখ্যাগুলিও কখন তার হাত ছাড়া হয়ে যায়। প্রায় চল্লিশ বছর পর স্বরূপ দত্ত সত্যজিৎ রায়ের পুরুলিয়া সংযোগ নিয়ে নতুন করে খোঁজ খবর শুরু করার পর হঠাত করেই সুনীলবাবু গল্পের ছলে তাঁকে এই লেখার বিষয়টি বলেন। একই সঙ্গে জানান, কাগজ পত্র সব হারিয়ে যাবার কথা।
এরপরই শুরু হয় স্বরূপ দত্তের অনুসন্ধান। পুরো লকডাউনের সময়টাতে শুধু সন্দেশের পুরনো সংখ্যা খুঁজে ফিরেছেন তিনি। যোগাযোগ করেছেন সত্যজিৎ পুত্র এবং পৌত্রের সঙ্গেও। বহু প্রচেষ্টার পর অবশেষে পাওয়া গেছে সেই সংখ্যাগুলি। উদ্ধার হয়েছে সুনীল মাহাতোর লেখা তিনটি গল্প। সেই গল্পগুলিকে আবার পাঠকদের সামনে তুলে ধরার জন্য নতুন করে একটি বই প্রকাশ করতে চলেছেন বিখ্যাত এই চিত্রশিল্পী। সেই সঙ্গে তিনি এই বইয়ে চল্লিশ বছরেরও বেশি আগে প্রকাশিত হওয়া গল্পগুলি কিভাবে খুঁজে পাওয়া গেল তার রোমহর্ষক বর্ণনাও দিয়েছেন।
কবি সুনীল মাহাতো স্বরূপবাবুর এই প্রয়াসের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এই বই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে পুরুলিয়ার সংযোগ তথ্য দিয়ে তুলে ধরেছে। সুনীল মাহাতোর কথায় একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক গ্রামের লাজুক তরুণকে যেভাবে সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রখ্যাত ম্যাগাজিনে স্থান দিয়েছিলেন তাতেই তাঁর মহত্ব প্রকাশ পায়। এই অনুপ্রেরণাই তাঁকে সাহিত্যের ময়দানে এতটা পথ চলতে সাহায্য করেছে বলে জানান সুনীল মাহাতো। এক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বর জন্মদিনে আরএক জন সাংস্কৃতিকের এর থেকে ভালো উপহার আর কী হতে পারে? মত গুণীজনদের।