Bengali language ভাষার অটুট বাঁধন আর আবেগই ধরে রেখেছে দুই বাংলার আত্মীয়তা

অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, কলকাতা, ২৯ ফেব্রুয়ারি: “ভাষার একটা নিজস্ব গভীরতা আছে। কোনও ভাষার সার্থক অনুবাদ আদৌ হয় কী? শেক্সপিয়র যা লিখেছেন, তার অনুবাদ হতে পারে, ভাবান্তর হবে কী করে”? বৃহস্পতিবার কলকাতায় এক আলোচনাসভায় এই মন্তব্য করলেন বিজেপি বিধায়ক, অর্থনীতিবিদ, পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের সদস্য তথা ভারত সরকারের প্রাক্তন প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অশোক লাহিড়ি। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সংঘের এই অনুষ্ঠানে ‘অমর ২১শে স্মরণে’ আলোচনার বিষয় ছিল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও বাঙালির আত্মত্যাগ’। আলোচনায় বক্তারা একটি বিষয়ে একমত হন। আর তা হল, ভাষার অটুট বাঁধন আর আবেগই ধরে রেখেছে দুই বাংলার আত্মীয়তা।

আলোচনায় অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের নৌ-পরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, উদ্যোক্তা সংঘের সভাপতি শিশির বাজোরিয়া ও কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার আন্দালিব ইলিয়াস।

বাংলাদেশের মন্ত্রী অনুষ্ঠানের মঞ্চে প্রধান অতিথির ভাষণে বলেন, দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং শেখ হাসিনা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে একটা উচ্চতম শিখরে নিয়ে গিয়েছেন। এই সম্পর্কের গভীরতার শিকড় অনেক গভীরে। একটা ভাষার একাত্মতা ও সাংস্কৃতিক বাঁধনে আবদ্ধ দুই বাংলা। আমাদের উভয়ের ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে একই রক্ত। পারস্পরিক বিশ্বাসের বন্ধন আমাদের এক সূত্রে বেঁধেছে। এর সূত্রপাত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের হাত ধরে।

১৯৪৭-এর পর থেকে বাংলাভাষার দাবির পটভূমি তুলে ধরে খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “আমরা দেশের স্বাধীনতার নেপথ্যে ভারতের অবদান সর্বদা মর্যাদার সঙ্গে স্মরণ করি। যুদ্ধে ভারতের ১২ হাজার মানুষ শহিদ হয়েছেন। এটা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এক কোটির ওপর শরনার্থী ভারতে, মূলত পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছিল। এই ব্যবস্থাপনা যে কত কঠিন, আমরা ১০ লক্ষ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে গিয়ে বুঝছি। আমাদের বিজয় অর্জনের জন্য চার দিক থেকে সাহায্য করেছে ভারত। বন্দী শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্ত করতে ভারত যে ভূমিকা নিয়েছিল, তা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।”

কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনার আন্দালিব ইলিয়াস তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, কেবল আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস উদযাপন করেই আমরা দায়িত্ব সারি না। ঢাকায় হয়েছে আমাদের আন্তর্জাতিক ভাষা কেন্দ্র। সেখানে নিরন্তর বিভিন্ন ভাষা নিয়ে চর্চা হয়। আপনাদের অনেকে নানা পরিবেশে কাজ করেন। কিন্তু সবার কাছে আবেদন করব, ঘরে আপনারা যে ভাষায় কথা বলেন, মায়ের কাছে যে ভাষায় কথা শিখেছেন, সেই ভাষায় কথা বলবেন। তাহলে ভাষাটা আরও কয়েকশো বছর বাঁচবে।

বাংলাদেশে তাঁর পরিচিত এক গুনী মানুষের নামোল্লেখ করে অশোক লাহিড়ি বলেন, “নিষ্ঠা সহকারে তিনি বিভিন্ন ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আমরা নিরন্তর এমন বাক্য ব্যবহার করি, যেগুলোর মধ্যে প্রাণের ছোঁয়া থাকে। সেগুলোর অনুবাদ হবে কী করে? সুকুমার রায়ের হযবরল-র অনুবাদ করেছেন আমার বন্ধু, যাদবপুরের ইংরেজির বিশিষ্ট অধ্যাপক সুকান্ত। কিন্তু সুকুমার রায়ের ছড়ায় যে প্রাণ, তা কখনও অনুবাদে পাওয়া সম্ভব? তবে, উন্নত সংস্কৃতির সঙ্গে ভাষার সমৃদ্ধির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। চিন্তার গভীরতার সঙ্গে বেড়ে চলে কোনও ভাষার শব্দভাণ্ডার।”

ভাষার পাশাপাশি আলোচনায় মাত্রা পায় দ্বিপাক্ষিক রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের বিষয়টিও। খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশিদের জন্য ভারতে এসে সহজে ভিসা দেওয়ার সুযোগ (ভিসা অন অ্যারাইভ্যাল) দেওয়ার আরজি জানালেন। তিনি বলেন, চিকিৎসার মত জরুরি কিছু বিষয়ে বাংলাদেশের লোকেরা ভারত, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের ওপর ভীষণ নির্ভরশীল। দ্রুত ভিসা না পেয়ে তাঁরা অনেক সময় সঙ্কটে পড়েন। নৌ-পরিষেবার সঙ্গে যুক্তরাও অনেকে সময়মত ভিসা পেলে উপকৃত হবেন। গতকাল আমি বাংলাদেশে ভারতের দূত প্রণয় ভার্মার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। তিনি বিষয়টি বিবেচনা করার আশ্বাস দিয়েছেন।

দু’দেশের মধ্যে জল-স্থল এবং ট্রেনপথে যোগাযোগের সুযোগ ক্রমেই বাড়ছে। এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের যে কোনও আপৎকালীন পরিস্থিতিতে ভারত যেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।“এই প্রসঙ্গে তিনি আলু-পেঁয়াজের আকালে ভারত সরকার যে জরুরি ব্যবস্থা নিয়েছে, তার উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশের মন্ত্রী বলেন, “শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যার পর যে পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাতে প্রতিবেশী দু’দেশের মধ্যে একটা তিক্ততা তৈরি করা হয়েছিল। তৈরির চেষ্টা হয়েছিল একটা অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরির। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সীমান্ত থেকে তৎপরতা চালিয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কড়া হাতে তা দমন করেছেন। এখন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কোনও উত্তেজনা নেই। যে ২-১টা ঘটনা ঘটে, তা নিছকই বিচ্ছিন্ন।”

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড পলিসির প্রাক্তন ডিরেক্টর, বিশ্বব্যাঙ্ক এবং  আন্তর্জাতিক একাধিক সংস্থার প্রাক্তন আধিকারিক অশোক লাহিড়ি বলেন, “আমার জন্ম এপার বাংলায়। কিন্তু ওপারে রয়েছে আমার পূর্বপুরুষের অনেক স্মৃতি। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের অন্যতম পরিচালক হিসাবে ছ’বছর বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছি। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তৎকালীন বেশ ক’জন বিশিষ্টের নামোল্লেখ করে তাঁদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠার কথা জানান তিনি।

বাংলাদেশে তাঁর পূর্বপুরুষের স্মৃতির রোমন্থন করতে গিয়ে অশোকবাবু বলেন, “আমার দিদা তাঁর তিন পুত্রকে নিয়ে এপারে আসতে উদ্যোগী হলে কুতুবউদ্দিন এগিয়ে এলেন। ওর ঘোড়ার গাড়ি দিদাদের পৌঁছে দিল রায়গঞ্জে। আমি অনেক পরে সেই কুতুবউদ্দিনের বাড়ি গিয়েছিলাম। ও বেঁচে নেই। কিন্তু ওর পরিবার রয়েছে। স্ত্রী-কে নিয়ে পূর্বপুরুষের ভিটেতে গিয়েছিলাম। যারা আবাসিক, আমার স্ত্রী-র গায়ে হাত বুলিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে বলল, “লাহিড়িবাড়ির বউ এয়েছে!” ডাব এনে খাওয়ালো। কত মধুর স্মৃতি! রক্তাক্ত দিনের কথা ভুলে গিয়ে আমাদের পারস্পরিক ভাল স্মৃতির কথা মনে রাখতে হবে। আমাদের মিল আত্মায়। এর মধ্যে কোনও কৃত্রিমতা নেই।”

আলোচনার শুরুতে শিশির বাজোরিয়া বলেন,
“বাংলাদেশে গিয়ে যথেষ্ঠ আতিথেয়তা পেয়েছি। আবার ওরা যেতে বলছে। কিন্তু আগামী মে মাস পর্যন্ত প্রচণ্ড ব্যস্ততা। এর মধ্যে আর পারছি না।“ আলোচনার শেষেও দু’দেশের উন্নত সম্পর্ক ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ওপর তিনি গুরুত্ব দেন।

সঙ্গীত পরিবেশন করেন বাংলাদেশের লালনগীতির বিশিষ্ট শিল্পী ফরিদা পারভিন এবং বংশীবাদক গাজি আব্দুল হাকিম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *