আমাদের ভারত, ৬ ডিসেম্বর: ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাস, জ্যোতি বসু, সুচিত্রা সেন। এমনই বহু কিংবদন্তির যোগসূত্র রয়েছে বাংলাদেশের সাথে। কেউ সেখানে জন্মেছেন, কারো বা পূর্বপুরুষের ভিটে রয়েছে সেখানে। কিন্তু মৌলবাদীদের অত্যাচার শুরু হতেই আঘাত নেমে আসতে শুরু করেছে সেই সব জায়গায়। মৌলবাদীদের রোষানল থেকে মুক্তি পায়নি ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি। ফলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, এই সব কিংবদন্তিদের স্মৃতি জড়িত ঘরবাড়ি অক্ষত থাকবে তো মৌলবাদীদের রোষানল থেকে? সেই আশঙ্কাই এখন এপারে।
আজ বাংলাদেশে হিন্দু ভাইবোনদের ওপর অত্যাচারে ছবি দেখে এপারের নাগরিকরা যেমন ক্ষুব্ধ তেমনই আহত। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ আলাদা রাষ্ট্র, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা তারকাটার এপার ওপার হয়নি, বরং আবেগের সম্পর্ক রয়ে গেছে। এপারে শিল্প ও সংস্কৃতির শেকড় খুঁজে পাওয়া গেছে ওপারে। বাংলায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়, কারো পূর্বপুরুষ, কারো নিজের জন্ম বাংলাদেশে। কিন্তু হিংসার আগুন আবেগকে আমল দেয় না। মৌলবাদীরা উদ্ধত হতেই প্রথম কোপ পড়েছে ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক ভিটেতে। রাজশাহীর ঘোড়ামারা মহল্লার যে বাড়িতে ঋত্বিক ঘটক পড়াশোনা করেছেন, শীতকালে সাহিত্য সঙ্গীত সম্মেলন উপলক্ষে যে বাড়িতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো গুণীদের আনাগোনা লেগে থাকত, বহু স্মৃতি বিজড়িত সেই বাড়ি গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যে মানুষটা দেশভাগের যন্ত্রণায় তিলে তিলে শেষ হয়ে গেলেন, তার বাড়িও রেহাই পেল না বাংলাদেশ মৌলবাদীদের হাত থেকে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম বাংলাদেশের মাদারীপুরে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতি বিচরিত পাঠাগার ওই বাড়িতে ছিল। তার অর্ধেক জীবন কেটেছে বাংলাদেশের ছায়ায়। তার ভিঁটেও দখল হয়ে গেছে বলে খবর। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী সাথী গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন, জমি কিনে বাড়ি করেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একটা ঘরে সুনীলের কিছু জিনিসপত্র ছিল। আরেকটা ঘরে দাতব্য চিকিৎসালয় করেছিলেন সুনীল। সেখানে গিয়ে খুব আদর যত্ন পেয়েছি, কিন্তু কয়েকজনের কাছ থেকে বিরূপ মন্তব্য শুনেছি। ওখানকার কয়েকজন বললো আপনাদের বাড়িটা দখল হয়ে গিয়েছে।
বাংলাদেশের পাবনায় জন্ম রমা দাশগুপ্তর। যিনি বাংলা সিনেমার মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর জন্ম ময়মনসিংহে। জীবনানন্দ দাশ জন্মেছিলেন বরিশালে। এখন আশঙ্কা আদৌ এইসব জায়গাগুলো মৌলবাদীদের হাত থেকে রক্ষা পাবে ?
সত্যজিৎ রায়ের ছেলে সন্দীপ রায় বলেছেন, ১৯৮৭ সালে যখন সুকুমার রায়ের ১০০ বছর উপলক্ষে ডকুমেন্টারিটা করার সময় বাংলাদেশের বাড়িতে তার প্রোডাকশন কন্ট্রোলার অনিল চৌধুরী বেশ কিছু ছবি তুলে আনেন, সেই ছবি দেখে বাবা খুব মর্মাহত হয়েছিলেন। ১৯৮৭ সালে যে অবস্থা তার থেকে বেশি কিছু উন্নতি হবে বলে মনে করছি না। জিনিসটা অক্ষত থাকলে ভালো হতো।
বাংলাদেশের বারদি গ্রামে জ্যোতি বসুর আদি বাড়ি। সেই বাড়ি রক্ষা করা যাবে তো?
১৯৬৪ সালে ঋত্বিক ঘটক লিখেছিলেন, আজ বাংলাদেশে আমরা গুন্ডামি করি। আমরা ধর্ম বিদ্বেষ প্রচার করি। এত বছরের আন্দোলন এখানে এসে পর্যবসিত হয়েছে। এ যে কত বড় মর্মান্তিক ব্যাপার, তা ভাবতে আমার কষ্ট লাগে। বাংলাদেশের তথ্যচিত্র যদি আমাকে তুলতে বলা হয় আমি তুলবোই না মশাই। দেশটি ক্রমশই ইতরের দেশ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর কোনো সৎ শিল্পীর নিজের দেশকে ইতর বলে দেখানো উচিত না। ব্যাপারটা অধার্মিক।