অশোক সেনগুপ্ত, আমাদের ভারত, ৩ সেপ্টেম্বর:
জানেন কী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বিপ্লবীকে ফাঁসি দেওয়ার পর দাহ করা হয়েছিল প্রেসিডেন্সি জেলের ভিতরে? তারিখ ছিল ১৯০৮-এর ২১ নভেম্বর। উত্তরটা জানাই, সত্যেন্দ্রনাথ বসু। কিন্তু এর কারণটা জানা আছে মাননীয় পাঠক? উত্তরটা হলো, তার ক’দিন আগে (১০ নভেম্বর) ওই জেলেই ফাঁসি হয় কানাইলাল দত্তর। তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে কেওড়াতলা মহাশ্মশাণে বিপুল জনতা সমবেত হন দেশভক্ত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে। তাই সত্যেন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে ওই ভিড়ের ঝুঁকি নিতে সাহস পাননি সরকার বাহাদুর।
এ রকম আকর্ষণীয় হাজারো তথ্যে সাজানো ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের কিছু অজানা কথা’, লিখেছেন এককালের সম্ভ্রান্ত স্বাধীনতা সংগ্রামী কালীচরণ ঘোষের পুত্র তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের বর্ষীয়ান গবেষক শিবশঙ্কর ঘোষ। এককথায় অসাধারণ বই। কেন, ‘অসাধারণ’ বিশেষণটা ব্যবহার করলাম, তা পরে ব্যাখ্যা করব। তার আগে খুব ছোট কিছু ব্যাকরণ/বানানের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
একসঙ্গে কি দুটি বহুবচন হয়? ইংরেজিতে যেমন মেনি মেন হয় না। পরে যদি বইয়ের সংস্করণ হয়, তখন নিচের কথাগুলো বিবেচনা করার আবেদন করবো—
যে সমস্ত বিপ্লবীদের (প্রকাশকের নিবেদন)
প্রচুর তরুণ যুবকেরা (পৃ ১৫)
যে সকল ….বিপ্লবীরা
কিছু ছেলেদের (পৃ ২৬)
যেসব ভারতীয়রা (পৃ ৬২)
অনেক ভারতীয়দের (পৃ ৬৫)।
কয়েকজন অনুচরদের (পৃ ৬৯)।
পৃ ১৪৩— এই দুই নিহত যুবকদের।
পৃ ১৫২ (২য় লাইন)— একদল যুবকদের।
এই বানানগুলো শুদ্ধ করা প্রয়োজন—
অকুতভয় (প্রকাশকের নিবেদন), দৌরাত্ম (পৃ ৮১), আবিশকার (১১৮),
এ ছাড়া—
*‘এই নির্দিষ্ট ব্যক্তিটির’ (পৃ ১৭)। ব্যক্তিটির লিখলে ‘এই’ ব্যবহার বাহুল্য।
*‘গোন্দলপাড়ায় ঐ বাড়িটি’ (পৃ ১০২)— ‘ঐ’ দরকার নেই।
*কিংসফোর্ডের বিষয়ে তাঁর, তাঁকে-র বদলে একবার তার, তাকে লেখা হয়েছে (পৃ ২৩, ৪র্থ ও ৫ম লাইন)।
*ওর হবে ওঁর (পৃ ২৭, ৯ম লাইন)।
*বেয়নট হবে বেয়নেট,
*বিবস্ত্রই যথেষ্ঠ নয় কি? কথাটার কি ব্যাকরণগত লিঙ্গবদল হয়? (দুটোই পৃ ৩৯)।
*কি হবে কী (পৃ ৪১ পৃঃ-র শেষের আগের লাইন)।
*‘মসার পিস্তল’ (পৃ ৫২, ৫৫)? অনেকে লেখেন ‘মাউজার’। অডিয়োতে ইংরেজি এবং জার্মান উচ্চারণ শুনলাম। দুটোই বলছে ‘মাউজা’।
*‘বিপ্লবিনী-পত্নী’ (পৃ ৯০), কথাটা ঠিক?
*পৃ ১০২-এর শিরোনামে এবং ১৪-তম লাইনে, পৃ ১০৩-এর ১৩ ও ১৬ লাইনে, পৃ ১০৪-এর ১১ লাইনে, পৃ ১০৬-এর শেষের আগের লাইনে ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ হবে রাইটার্স বিল্ডিংস’।
*‘পরীক্ষার্থিনী’ (পৃ ১১৭), কথাটা কি ঠিক?
পৃ ১২০— তাকে হবে তাঁকে।
পৃ ১২৩— কালোবাজর হবে কালোবাজার।
পৃ ১২৫— মেল হবে মে।
পৃ ১৩২— বার্জ্জ, না বার্জ হবে? ১৪৮ পৃষ্ঠায় ৬, ১২ ও ১৬ লাইনে ও ১৫২ পঃ ৬ লাইনে কিন্তু লেখা হয়েছে বার্জ।
পৃ ১৪৫— চারবার লেখা হয়েছে মনীন্দ্র। কিন্তু
অধ্যাপক ডঃ পবিত্র সরকারের ব্যাবহারিক বাংলা বানান-অভিধানে বানানটা লেখা হয়েছে মণীন্দ্র (পৃ ৪৯৫)। তবে, খুব খুঁটিয়ে পড়লে অনেক বইয়ে ছোটখাটো এরকম কিছু বিচ্যুতি থাকে।
স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সংগ্রামীদের নিয়ে নিষ্ঠাভরে চর্চা করেন, এরকম মানুষের সংখ্যা এখন আর খুব বেশি নেই। শিবশঙ্কর ঘোষকে যাঁরা ঘনিষ্ঠভাবে জানেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে ওই তালিকার ওপরদিকে তাঁকে রাখবেন শ্রদ্ধার সঙ্গে। ৮৩ বছর বয়সেও তাঁর কম্পিউটার-মস্তিষ্কের নানা খোপে যত্ন করে ধরে রেখেছেন বিভিন্ন তথ্য। তথ্যের উৎস চাইলে চট করে উঠে আলমারি থেকে প্রামান্য বই খুলে দেখিয়ে দেবেন সেই উৎস। দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, “লোকে খাবে বলে তথ্যের সঙ্গে কোনওভাবে আমি আপোষ করতে পারবো না।
কেন অসাধারণ লেগেছে বইটা? এর প্রথম উত্তর, অত্যন্ত সহজ, সরল বাংলা। ছোটো ছোটো বাক্য। ইংরেজদের লক্ষ্য করে অহেতুক একটি নেতিবাচক শব্দও নেই। স্কুলের ছেলেমেয়েরাও সানন্দে পড়তে পারবে। দ্বিতীয় কারণ, একটা বহুবর্ণের বিপ্লবীকে অল্প কথায় নিয়ে আসা। এই বইয়ে যাঁদের আলোচনা করা হয়েছে, তাঁদের অনেকের ওপর একটা পৃথক বই লেখা সম্ভব। ১৭০ শব্দের মধ্যে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে শিবশঙ্করবাবু এই বইয়ে এনেছেন, যেটা করা খুবই দুষ্কর। তৃতীয়, সুন্দর ছাপা, ছবি। চতুর্থ, আমাদের অনেকের ধারণা নেই, বহির্বঙ্গে কিভাবে জীবনমৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করেছিলেন কত স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। বইটা পড়লে সেই ধারণা অনেকটা স্পষ্ট হবে। পঞ্চম, বইয়ের শেষে ফাঁসির তালিকা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ৬০টি প্রশ্নোত্তর।
লেখক জানিয়েছেন, “এই বইয়ে আমার বইয়ের বিরাশিটা গল্পে মোট একশো আটচল্লিশ জন বিপ্লবীর কথা লেখা আছে। এঁদের মধ্যে বাহাত্তর জন হলেন ফাঁসির শহীদ। এই বাহাত্তর জনের মধ্যে তেত্রিশ জন হলেন অবাঙালি এবং উনচল্লিশ জন বাঙালী।” সূচিপত্রের সঙ্গে একটা আলাদা এক পাতা জেরক্স কাগজ (হাতে লেখা) দিয়েছেন লেখক। তাঁর কথায়, “সেটা দেখলেই সব বোঝা যাবে। এঁদের সবার কথা কিন্তু ওই বিরাশিটা গল্পে নেই। বিরাশিটা গল্পের খবর ওই হাতে লেখা তালিকা থেকে পাওয়া যাবে।”
শিবশঙ্কর ঘোষ অবশ্য দাবি করেছেন, গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন ইন্সটিট্যুট অফ কালচারের স্বামী ইষ্টব্রতানন্দ, ও প্রকাশক ‘শাশ্বত নির্ভীক পথিক’-এর সুশান্ত দত্ত-সহ কয়েকজনের প্রগাঢ় অনুপ্রেরণা না থাকলে বইটা হয়তো প্রকাশ হতোনা। মোট ১৮০ পৃষ্ঠার বই। মূল্য ২০০/-। বিভিন্ন ক্লাব এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজকাল কৃতী পড়ুয়াদের পুরস্কৃত করে। ওই সব অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের কাছে যদি বইটির কথা জানানো যায় এবং তাঁরা এই বই পুরস্কৃতদের দেন, বরাদ্দ অর্থ বৃথা যাবে না।