আশিস মণ্ডল, রামপুরহাট, ২১ মে: ধ্বংসস্তুপ থেকে উঠে দাঁড়ানোর লড়াই। শুধু ধ্বংসস্তুপ নয়, তার সঙ্গে রয়েছে অভাব অনটন। সেই আর্থিক অস্বচ্ছলতার বিরুদ্ধে মানসিক লড়াই করে তারই দৃষ্টান্ত রাখল বগটুই গ্রামের সামিয়া সুলতানা। বোমা বারুদ আর পোড়া লাশের গন্ধের বিভীষিকাকে হেলায় হারিয়ে এবার মাধ্যমিকে রামপুরহাট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বগটুই গ্রামের নাম উজ্জ্বল করার চেষ্টা করেছে সে। বগটুই গ্রামে শিক্ষার আলো ফেরানোই এখন একমাত্র লক্ষ্য সামিয়ার।
সামিয়া সুলতানার বাড়ি বগটুই গ্রামের পূর্বপাড়ায়। ওই পাড়াতেই গত বছরের ২১ মার্চ তৃণমূল নেতা ভাদু শেখকে বোমা মেরে খুন করা হয়। তার বদলা নিতে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় ১০ জনকে। তাদের মধ্যে এক শিশুকন্যা ছিল। মৃত্যু হয়েছিল এক নবদম্পতির। এরপরে গ্রামে যান মুখ্যমন্ত্রী, পুরমন্ত্রী, সিবিআই। একের পর এক ভিআইপির আগমনে পুলিশের গাড়ির ধুলোয় ঢেকেছিল বগটুই গ্রাম। প্রতিদিন ধরপাকড়ে এবং পুলিশের দাপাদাপিতে আর পাঁচটি পরিবারের মতো আতঙ্কে ছিল সামিয়া এবং তার পরিবার। ফলে পড়াশোনায় কিছুটা ব্যাঘাত ঘটলেও দৃঢ় মানসিকতার জোরে সাফল্য লাভ করেছে সামিয়া। শিক্ষার মাধ্যমেই বগটুই গ্রামের বদনাম ঘোচানোর চেষ্টা করেছে সে।
সামিয়ার বাবা মহম্মদ জাফর উদ্দিন শেখ পেশায় রামপুরহাট হাইমাদ্রাসার ভোকেশনাল শিক্ষক। নামেই শিক্ষক। সেখান থেকে খুব একটা পারিশ্রমিক মেলে না। মা নার্গিস হাসিনা গৃহবধূ। দুই ছেলে মেয়ের মধ্যে বড় সামিয়া। ছেলে মহম্মদ ইউসুফ শেখ রামপুরহাট জিতেন্দ্রলাল বিদ্যাভবনের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। সামান্য আয়ে দুই ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয় বাবা জাফরকে। তবে পাশে পেয়েছিলেন শ্বশুর মহম্মদ হুমায়ূন উদ্দিনকে। মুর্শিদাবাদের একটি স্কুলের ফিজিক্সের শিক্ষক হুমায়ুনের আর্থিক সহযোগিতায় চরাই উতরাই পেরিয়ে সাফল্যের লক্ষ্যে পৌঁছেছে নাতনি সামিয়া। সামিয়া আগামীদিনে অধ্যাপক হয়ে বগটুই গ্রামের হানাহানি বন্ধ করে শিক্ষার আলো ফেরাতে চায়।
সামিয়া জানায়, বগটুই গ্রামের নাম শুনলেই এখনও অনেকে ভ্রু কোঁচকায়। কেউ কেউ কুটুক্তিও করেছে। আমার জেদ ছিল মাধ্যমিকে ভালো ফল করে গ্রামের বদনাম ঘোচাব। ৬৪৯ নম্বর পেয়ে সেই সংকল্প কতটা রাখতে পেরেছি জানি না। তবে আগামী দিনে অধ্যাপক হয়ে বগটুই গ্রামে শিক্ষার আলো ফেরাবই।”
সামিয়ার ফলাফল বাংলায় ৯৩, ইংরেজিতে ৯৩, গনিতে ৮৭, ভৌতবিজ্ঞানে ৯৮, জীবনবিজ্ঞানে ৯৩, ইতিহাসে ৯১ এবং ভূগোলে ৯৪। গনিতে আরও নম্বর আশা করেছিল সামিয়া। তবে মেয়ের সাফল্যে খুশি বাবা মা। তবে মেয়ের উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিবন্ধকতা ভাবাচ্ছে বাবা মাকে।
এদিকে বগটুই গ্রামের মেয়ের সাফল্যের খবর পেয়ে তাদের বাড়িতে ছুটে যান তৃণমূলের রামপুরহাট ১ নম্বর ব্লক সভাপতি সৈয়দ সিরাজ জিম্মি। গত বছরের ২৪ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ব্লক সভাপতি ঘোষণা করে গিয়েছিলেন। তিনিও বগটুই গ্রামের বদনাম ঘোচাতে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। গ্রামে কোচিং ক্যাম্প খুলে নিয়মিত বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক পাঠানো হয়েছিল। সৈয়দ সিরাজ জিম্মি এদিন বলেন, এখন ভালো লাগছে এই গ্রাম থেকেই মাধ্যমিকে সামিয়া সাফল্য লাভ করেছে। ওর পড়াশোনার ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিবন্ধকতা হতে আমরা দেব না। মুখ্যমন্ত্রী বগটুইকে মডেল গ্রাম করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। সামিয়ায় হবে আমাদের সেই মুখ।”