ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ৭ জানুয়ারি: আজাদ হিন্দ সরকারের সর্বাধিনায়ক তথা ‘স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী’ নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন এক বিরল দেশপ্রেমের অধিকারী। দেশবাসীর অন্তরে স্বরাজ-সাধনায় তখন নানান ধারা সংরক্ষিত হচ্ছিল। বাস্তবতার মাটিতে সেই সব ধারাকে একযোগে দাঁড় করালেন তিনি। বঙ্কিম, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্র ও অরবিন্দের চেতনায় স্বরাজের ভিন্নতর ধারা প্রবাহিত ছিল। যাবতীয় ধারাকে সমন্বয় করে বাস্তবের মাটিতে নামিয়ে আনার কৃতিত্ব সুভাষের। স্বরাজ্য ভাবনায় তাই তিনি মহারথী। ভারতমাতার পূজায় তিনি নানান মনীষীর ফুল একত্রে গেঁথে মালা রচনা করেছিলেন।
বঙ্কিম-মানসে ছিল অখন্ড-জাতির ভাবনা, অসুর বিনাশের যজ্ঞ; অর্থাৎ সাহিত্য-স্বরাজ। স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে প্রবাহিত হত ধর্মীয়, অধ্যাত্মিক ও সামাজিক স্বরাজ। রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাধনার মধ্যে মুক্তি পেল ভারতবর্ষের অখণ্ড চেতনার রূপ-রস-গন্ধ। শ্রী অরবিন্দ ঘোষ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের বীণাযন্ত্রে বেঁধে দিলেন রাজনৈতিক স্বরাজের সুর। এই সকল পথের কোরাস সঙ্গীত দিয়ে শুরু হল স্বাধীন ভারতবর্ষ গঠনের জন্য যুদ্ধ; সুভাষ হলেন তার মহাধিনায়ক। বিশ্বের সকল ঘটনাকে বাস্তবতার লাশকাটা ঘরে কাটাছেঁড়া করে, তিনি শত্রু-মিত্র জটিলতাকে সহজ সরল রূপ দিলেন, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ যার অন্যতম চালিকাশক্তি। দেশবিরোধী শক্তি তাঁকে নানান গালমন্দে ভূষিত করল; খসে পড়ল নানান ব্যক্তিত্বের রাজনৈতিক মুখোশ। কিন্তু নেতাজী অনন্য। আত্মত্যাগ ছাড়া যে রাজনীতির লড়াইয়ে শাশ্বত জয় সম্ভব নয়, তা তিনি ভারতবাসীকে, ভারতের রাজনীতিবেত্তাদের বুঝিয়ে দিলেন। রাজনৈতিক মঞ্চে যতদিন না তাঁর সংগ্রাম, চরিত্রশক্তি, নিঃস্বার্থপরতা, মানবিকতা, প্রাণময়তা, অভিজ্ঞতাকে আমরা মূলধন না করবো ততদিন তাঁর আত্মার শান্তি নেই; রাজনৈতিক পরগাছা থেকে মুক্তি নেই ভারতবর্ষের। আত্মত্যাগের বাণীই ছিল নেতাজীর রাষ্ট্রচেতনার মূলতত্ত্ব, এটা যেন আমরা মনে রাখি।
পরাধীনতা থেকে ভারতবর্ষের মুক্তিলাভ আজাদ হিন্দ ফৌজের কারণেই ঘটেছিল, তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার। “সুভাষচন্দ্রের ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠনের ফলে ইংরেজ বুঝিতে পারিল যে প্রধানত যে ভারতীয় সিপাহী সৈন্যের সহায়তায় তাহারা ভারতবর্ষ জয় ও এতদিন রক্ষা করিয়া আসিতেছিল, অতঃপর তাহাদের উপর আর নির্ভর করা যায় না। সুতরাং ইংরেজ শ্রমিকদল মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিয়াই ভারতবাসীকে স্বাধীনতা দিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিল।” ড. মজুমদারের মত এখনও ভারতবর্ষের অসংখ্য ইতিহাসপ্রেমী প্রবুদ্ধ মানুষ মনে করেন, ভারতের মুক্তিলাভের কৃতিত্ব একলা মহাত্মা গান্ধীর প্রাপ্য নয়। হৃদকম্প বাড়ানো দুটি ঘটনার পর ব্রিটিশরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ দৌত্যকার্যের সূত্রপাত করেছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতার লক্ষ্যে। প্রথম, জাপানি সৈন্য রেঙ্গুন দখলের পরে পরেই ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিতে ভারতে আসেন ব্রিটিশ দূত স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস; আজাদ হিন্দ ফৌজ তখন জাপানে দানা বাঁধছে।
দ্বিতীয়, নেতাজীর বীরত্বে ও কর্মে দেশীয় সেনানীদের মধ্যে ইংরেজদের প্রতি অনুগত্যের শিথিলতা ঘটালো। তাই নৌ-বিদ্রোহের পরদিন ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, স্বাধীন ভারতের সংবিধান সংক্রান্ত কাজে শীঘ্রই ভারতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে মিলিত হতে আসবেন তিন সদস্যের ক্যাবিনেট মিশন। তাছাড়া ১৯৪৭ সালের অনেক আগেই গান্ধীর সক্রিয়তা বন্ধ হয়েছিল। ১৯৩৩ সালে গান্ধীর ডাকে আইন অমান্য আন্দোলন ব্যর্থ-পরিত্যক্ত হয়েছিল। ফলে ১৯৪৭ সালে এমন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেনি, যার জন্য রাজ্যপাট ছেড়ে চলে যাওয়া যায়। প্রকৃত কারণ অবশ্যই নেতাজি এবং তার আজাদ হিন্দ ফৌজ। ব্রিটেনের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছিলেন নেতাজী।
ক্ষমতা হস্তান্তর পর্বে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড অ্যাটলি-র ঐতিহাসিক উদ্ধৃতির সাক্ষ্য হাজির করেছিলেন ড. মজুমদার। অ্যাটলি পরে স্বীকার করেছেন, ইংরেজদের তাড়াহুড়ো করে ভারত ত্যাগের মূল কারণ হলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং গান্ধীর কার্যকলাপের প্রভাব ন্যূনতম। সমাজের বোধ অনুসারে নেতা ত্রিবিধ। উত্তম, মধ্যম আর অধম; সে রাজনৈতিক নেতাই হোন আর সামাজিক-আধ্যাত্মিক নেতা! উত্তম নেতাকে দেশ, জাতি, কাল কম সময়ের জন্য পান। তারা অনেকটা ‘উসকো কাঠি’-র মতো; আমাদের চেতনায় কেবল অগ্নি প্রজ্বলন করতেই আসেন। আমাদের বোধের দোরগোড়ায় বাতিদান করে যান, চিন্তা-চেতনাকে ওলট-পালট করে যান, এক প্রবল ঘুর্ণিঝড় যেন। উত্তমকে বেশি সময় বাঁধা যায় না, প্রয়োজনও হয়তো নেই। উত্তম নিজেও জানেন, তার কাজ ফুরোলে আর বিলম্ব নয়…..। পৃথিবী বরং মধ্যম নেতাদের পেয়েই সুখে থাকে। পৃথিবী গড়পড়তায় মধ্যম মানকেই চিরয়ত করতে চেয়েছে, হয়তো পেরেছে। উত্তমের দ্যুতি সইতে পারার ক্ষমতা আমাদের নেই, সেই প্রবল ঝড় যদি একবার শুরু হয়, তা আটকানোর সাধ্যি নেই কারো। মধ্যম নেতা নিজেও তা ভালোভাবে জানেন। সব প্রতিষ্ঠানেই উত্তমের রাজ্যাভিষেক এক বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনা। তাই বেহুঁশ হয়ে আমরা উত্তমকে নিত্য খুন করি, সতত গায়েব করি, তাকে অপ্রাসঙ্গিক করার সার্বিক চেষ্টায় রত হই। কিন্তু তার জ্যোতি এতটাই, তার স্বরূপ এতই চিরায়ত, তাকে চাপা দিয়ে রাখা যায় না; ঠিকরে বেরিয়ে আসে বলার্কপ্রভ-র মতো, ইতিহাসের অমল পাঠে তা বারবার ফিরে আসে।
মধ্যম নেতাকে নিয়েই মানুষ খুশি থাকেন। মধ্যম তার মধ্যবিত্ত মানসিকতা দিয়ে মানুষের খুশির ভোল বদল করিয়ে নিতে জানেন, জানেন কখন উত্তমের নামে জয়ধ্বনি দিতে হয়, কখন উত্তমকে আচ্ছামত গালমন্দ করে নিজের নোলা-সাম্রাজ্য বজায় রাখতে হয়। মধ্যম মানে হল অধমকে ব্যবহারের অপূর্ব মুন্সিয়ানা। পৃথিবী মধ্যমকে জয়ী করাতে চায় বলেই মধ্য-মেধার এত জৌলুশ! উত্তমের রয়েছে ‘স্টাইল’, একান্তই নিজস্ব, অমৃতের ঐশী চেতনা-সম্ভূত। মধ্যমের রয়েছে ‘ফ্যাশান’, যেন নিউমার্কেট থেকে কেনা বিদেশি পরবের সস্তা-পোষাক!
অধমকে চিরকাল মধ্যম নেতা ‘ভর’ করেছে, বেচারা বুঝতেও পারেননি, সে নেতা হবার যোগ্য নয়; মধ্যমান সংরক্ষণের সে এক ঐতিহাসিক ‘বোড়ে’। অধমকে ব্যবহার করে মধ্যম উত্তমের বলিদান প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করেছে। তারই পারিতোষিক দেওয়ার প্রক্রিয়া জারি ইদানীং। অধমের বংশানুক্রমিক ভরণপোষণের দায়-দায়িত্ব নিয়েছে যেন! মানুষের অনন্ত লোভ-মোহ-ইচ্ছে মানুষকে উত্তম চেনার দুয়ারকে চিরকাল রূদ্ধ করে রেখেছে। মানুষ যতদিন না মধ্যমণিকে সোনার গোপাল বলে জড়িয়ে রাখবে ব্রজ-বালককে সে খুঁজে পাবে না। ভবের মাঝি, আমায় কী উত্তম নায়ে নিতে পারো না?
ছাড়িলাম মধ্যম নাও/দুরন্ত সমুদ্রে/হারালাম মাঝের বোধ/মানসিক শূদ্রে। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এমনই এক বিরলতম উত্তম নেতা। যার নৌকোয় ভাসলে দেশ অখণ্ড ও সুরক্ষিত থাকতো। তাই কবিশেখর কালিদাস রায় ‘সুভাষ তর্পণ’ করতে গিয়ে বলেছিলেন, “নহ তুমি ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ ভীম, নহ যুধিষ্ঠির গীতামন্ত্র শুনিবার একমাত্র যোগ্য তুমি বীর। এ যুগে গাণ্ডীবী তুমি তুমি মহারথ, তোমা বক্ষে ধরি ধন্য এ মহাভারত।”