বাংলায় পুষ্পাঞ্জলি অ-শাস্ত্রীয়, বললেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

আমাদের ভারত, ২ অক্টোবর: দুর্গাপূজা উপলক্ষে বোধনের প্রাক্কালে পাণ্ডুয়ার বেলুন গ্রামে প্রতি বছরই মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন স্থানীয় বারোয়ারী পূজা কমিটি। নিষ্ঠাভরেই সেই পূজার আয়োজন হয়– গ্রাম-বাংলার শিকড়-সংস্কৃতি সেই আয়োজনে প্রকাশিত হয়ে ওঠে।

হুগলির বেলুন গ্রামের হেঁপাকালী এক জাগ্রত থান, সশ্রদ্ধ বিশ্বাস ও ভরসার স্থল। সেখানে কালীপুজো তো নিষ্ঠা ভরে হতই, বারোয়ারী দুর্গাপূজাও এবার তেষট্টি বছরে পড়ল। চারিদিকে সবুজ খেত, কৃষি বাস্তুতন্ত্রের পরত, তার মাঝে এক সম্ভ্রান্ত গ্রাম ‘বেলুন’। পাণ্ডুয়া স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার ভেতরে। দেবী আরাধনার সঙ্গে আনন্দ উৎসবের অঙ্গ হিসেবে এই দিন ছিল শিশুদের জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন, এলাকার কৃতি বিদ্যার্থীদের পারিতোষিক প্রদান এবং দুঃস্থ গ্রামবাসীদের বস্ত্র বিতরণ। এমনই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে দুর্গাষষ্ঠীর দিন আমন্ত্রিত ছিলেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা হিন্দু সংস্কৃতি রক্ষার এক অতন্দ্র-প্রহরী অধ্যাপক ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।

তিনিই শুভ সূচনা করেন এদিনের অনুষ্ঠান। নিজের বক্তব্যে দেবী মাহাত্ম্য বর্ণনা করলেন, ব্যাখ্যা করলেন নবরাত্রি অনুষ্ঠানের তাৎপর্য। তারপরই উত্থাপন করলেন বাংলাভাষায় দেবীর পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র শাস্ত্র-সম্মত কিনা, দেবীর হাত থেকে শস্ত্র অপসারণ করা উচিত কিনা ইত্যাদি বিষয়ে।

অধ্যাপক চক্রবর্তী বলেন, দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, সরস্বতী পূজা — এগুলি এক একটি কাম্য-পূজা, নিষ্কাম দেবী আরাধনা নয়। তাই সংকল্প করেই তা করতে হয়। শাস্ত্র বিচার করে সংকল্প ও কৃত্য করলে কামনা সফল হয়। তাই বাংলায় নয়, সংস্কৃত ভাষাতেই দেবীমন্ত্র পাঠ করতে হবে, তবেই তা শাস্ত্র-সম্মত হবে। তবে বাংলায় তার ভাব-অনুভব জানা যেতেই পারে৷ সংস্কৃত ভাষা হচ্ছে, বাংলা ভাষার জননী। সেই জননী মৃত নয়, তাই তাকেই মান্যতা দিতে হবে। পারিবারিক অনুষ্ঠান যেমন বিবাহ, উপনয়ন সংস্কার ইত্যাদির আমন্ত্রণ পত্রে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যের নামেই প্রচার ও আমন্ত্রণ জানানো হয়। ঠাকুরদাদা বেঁচে থাকতে বাবার নামে আমন্ত্রণ পত্র ছাপানো হয় না। সেই রকম বাংলা ভাষার মাতামহী সংস্কৃত ভাষা জীবিত থাকতে সেই ভাষাতেই পূজার মন্ত্র পাঠ হওয়া উচিত। কোনো রকম পরীক্ষা এখানে চলে না।

অধ্যাপক চক্রবর্তী বলেন, কলকাতার অধিকাংশ বারোয়ারী পূজা থিমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, সেখানে প্রকৃত শাস্ত্রীয় আচার পালিত হয় না। শস্ত্র-বিধান ব্যাতিরেকে দেবী পূজা অসম্পূর্ণ। শাস্ত্রকে মর্যাদা দিয়েই দুর্গাপূজার যাবতীয় কৃত্য সাধন করতে হবে। অধ্যাপক চক্রবর্তী আরও বলেন, অকাল বোধনের মাধ্যমে মর্ত্যলোকে দেবী দুর্গার প্রচলন করেছিলেন মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র। তাঁর আরাধ্যা দেবী দুর্গা যদি বাঙালির দেবতা হন, তবে শ্রীরামচন্দ্রও বাঙালির উপাস্য। অধ্যাপক চক্রবর্তী মনে করিয়ে দেন ভগবান রামচন্দ্র বাঙালিরও দেবতা।

এদিন বিশেষ অতিথি হিসেবে সভায় উপস্থিত ছিলেন পাণ্ডুয়ার বিশিষ্ট নাগরিক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, সভামুখ্য ছিলেন বারোয়ারী পূজা কমিটির সভাপতি শুকদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানে আগমনী গান শোনান স্থানীয় শিল্পীরা। স্থানীয় বাচিক শিল্পী উদাত্ত গলায় পরিবেশেন করেন দেবী চণ্ডীর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি স্তোস্ত্র। কমিটির তরফ থেকে স্থানীয় মানুষের দ্বারা রচিত এবং সাহিত্য-সুবাসিত একটি স্যুভেনির প্রকাশিত হয়। স্যুভেনিরটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেন অধ্যাপক চক্রবর্তী। অঙ্কন প্রতিযোগিতার পুরস্কারও তিনি বিজয়ী প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে তুলে দেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার স্থানীয় কৃতি ছাত্রদের সম্মান জানানো হয় এদিনের অনুষ্ঠানে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *