জয় লাহা, দুর্গাপুর, ১ অক্টোবর: মদ্যপ স্বামীদের অত্যাচারে অতিষ্ট মহিলারা। পান গুমটি থেকে গৃহস্থের বাড়ি– অবাধে চলছে অবৈধভাবে মদ বিক্রি। আর ওই মদের নেশায় আসক্ত স্বামীরা। সংসার অনটনে জর্জরিত। আর তাই অত্যাচারের হাত থেকে সংসার বাঁচাতে করুন আর্তি কাঁকসা থানার বনকাটি পঞ্চায়েতের সাতকাহানিয়া গ্রামের মহিলাদের। অত্যাচারিতদের আবেদনেও নির্বিকার রাজ্যের আবগারি বিভাগ।
কাঁকসার জঙ্গলমহলে অজয় নদী তিরবর্তী সাতকাহানিয়া গ্রামের বাউরী পাড়া। শ’খানেক পরিবারের বসবাস। বেশীরভাগই পেশায় দিনমজুর। বছরখানেক ধরে বন্ধ ১০০ দিনের কাজ। অনটন গ্রাস করছে ওইসব অনগ্রসর পারিবার। মাঠে চাষের কাজ না জুটলে অজয় নদীর বালিঘাটে কাজ করে গ্রামের বেশীরভাগ পুরুষ। অভাবঅনটন নিত্যসঙ্গী। তারমধ্যেই কোনওভাবে দিনমজুর খেটে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। সংসারের হাল টানতে গ্রামের মহিলারা স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করেছে। করোনা মাহামারি কাটিয়ে আর্থিক অনটনে জর্জরিত। তাই গোষ্ঠীর উদ্যোগে নানান কাজ করে স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে এগিয়ে চলতে আদম্য ইচ্ছা মহিলাদের। এমনকি গ্রামে সুষ্ঠ শৃঙ্খলাবদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে আগ্রহী। অভিযোগ, গ্রামের একটি পান গুমটি ও ৬ টি পরিবার বেআইনী মদ বিক্রি করে চলেছে কয়েকবছর ধরে। যার পরিণামে গ্রামের পুরুষরা মদ্যাপানে আসক্ত হয়ে পড়ছে।
সারাদিনে যা রোজগার করে, বিকাল হলেই মদ্যপান করে বাড়ি ফেরে। মদ্যপ অবস্থায় বাড়িতে অশান্তি করে। পরিবারের স্ত্রীদের মারধর থেকে নানানভাবে অত্যাচার করে। আর এই মদ্যপ স্বামীদের অত্যাচারে অতিষ্ট স্ত্রী ও সন্তানরা। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি পরিবার সর্বাশান্ত হয়ে পড়েছে। তারা একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা লাটে উঠেছে। পুজোর মরশুমেও গোটা গ্রামজুড়ে অশান্তির আবহ বয়ছে।
গ্রামের সুষ্ঠ সামাজিক পরিবেশ নষ্ঠ হচ্ছে। এমনকি মহিলারা চরম নিরাপত্তাহীনতায় অসহায় হয়ে পড়েছে। তাই সুবিচারের আশায় প্রশাসনের শরণাপন্ন। বর্তমান সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে গ্রামে সুষ্ঠ সামাজিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে মহিলারা।
নির্মম অত্যাচারের শিকার গৌরি বাউরী, বৈশাখী বাউরী, শিলা বাউরী, নমিতা বাউরী জানান, “বালিঘাটে দু’শ টাকা রোজগার করলে ১০০ টাকার মদ খেয়ে আসে। ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার চালাতে হিমসিম খেয়ে যাই। এক’শ দিনের কাজ প্রায় একবছর ধরে বন্ধ রয়েছে। বালিঘাট কিম্বা দিনমজুর করে যেটুকু হয়, তার মজুরী তুলে মদ খেয়ে নেয়। কিছু বললেই, রান্না করা খাবার ছুড়ে ফেলে দেয়। নির্মমভাবে মারধর করে। জিনিসপত্র ভাঙ্গচুর করে। প্রতিবাদ করলে আরও বেশী অত্যাচার করে। মদ্যপ স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ট।”
মহিলারা আরও জানান, “মাতাল বাবার আচরণে ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা লাটে উঠেছে। রাত হলেই অত্যাচার শুরু। কখনও মারধর করে বাড়ির বাইরে বের করে দেয়। সারা রাত অন্ধকারে বসে বুকফাটা আর্তনাদ ছাড়া কিছুই ভেসে আসে না।
এই অবস্থায় স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদেরও হতাশা গ্রাস করছে। মদের গ্রাসে বেশকয়েকটি পরিবার সর্বশান্ত হয়ে পড়েছে। অর্থাভাবে কাজ করতে পারছে না তারা। সংসারে অশান্তির কারনে মহিলাদের কাজে মন নেই। গ্রামের মহিলাদের করুন অর্তি, “আমরা শান্তিতে বাঁচতে চাই। তাই ওইসব বেআইনীভাবে মদ বিক্রেতাদের কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ করেছি গ্রামে মদ বিক্রি বন্ধ করুন। কিন্তু, কোনও সুরাহা হয়নি। আমাদের দেখে উপহাস করছে।” মহিলারা জানান, “খবরের কাগজে, টিভির পর্দায় যখন মা দূর্গার সঙ্গে মহিলাদের তুলনা করে স্বনির্ভর মহিলাদের খবর দেখানো হয়। তখন আমাদের বুকের মধ্যে অনেক কষ্ট হয়। আমরাও স্বনির্ভর হতে চাই। রোজগার করে সংসার চালিয়ে ছেলে মেয়েদের মানুষের মত মানুষ করতে চাই। কিন্তু তার পথের কাঁটা গ্রামের মদ বিক্রি। দুচোখে স্বপ্নগুলো মদ্যপ স্বামীদের অত্যাচারে শেষ হয়ে গেছে। তাই প্রশাসনের কাছে আবেদন, গ্রামে বেআইনী মদ বিক্রি বন্ধের করুক। মহিলাদের নিরাপত্তার স্বার্থে এলাকায় পুলিশ টহলের ব্যবস্থা করুক।”
মাস কয়েক আগে ওই একই পঞ্চায়েতের কোটালপুকুর গ্রামের মহিলারা অভিযোগ তুলে সরব হয়েছিল। তারপর আরও একটি গ্রামে একই অভিযোগে আবগারি দফতরের ভুমিকায় প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্ন, অনুমতি ছাড়া কিভাবে চলছে গ্রামে বেআইনী মদ বিক্রি? যার কবলে গ্রামটা সর্বশান্ত হচ্ছে।
যদিও কাঁকসা আবগারি বিভাগ কোনও উত্তর দেয়নি। তবে বনকাটি পঞ্চায়েত প্রধান পিন্টু বাগদী জানান, “বহুবার ওই পরিবারগুলোকে গ্রামে মদ বিক্রি বন্ধের জন্য বলেছি। কিন্তু শোনেনি। বিষয়টি পুলিশ ও ব্লক প্রশাসনকে জানাচ্ছি।”