Mahakumbho, । । ৭। । “সত্যি, অষ্টপ্রহর মানুষের সঙ্গেই বাস করি। মানুষের কত রূপ দেখি। কিন্তু যেখানে চলেছি, সেখানে আরও কত মানুষ, কত তার রূপ!”—কালকূট (অমৃত কুম্ভের সন্ধানে)

*মহাকুম্ভ ২৫*

অশোক সেনগুপ্ত, আমাদের ভারত, ২৭ জানুয়ারি:
২০২৫ মহা কুম্ভ মেলার বিশেষ তাৎপর্য আছে। কারণ এটি ১২টি কুম্ভ মেলা চক্রের সমাপ্তি হিসেবে চিহ্নিত৷ এই বছরের মহা কুম্ভের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে, টিকারমাফি আশ্রমের প্রধান মহন্ত হরিচৈতন্য ব্রহ্মচারী বলেছেন, “এই মহাকুম্ভের সময় ২৯ জানুয়ারি, গুরুত্বপূর্ণভাবে, ‘পুখ নক্ষত্র’ এর সাথে সারিবদ্ধ হবে চারটি গ্রহ। এইভাবে, বিগত ১৪৪ বছরের সমস্ত কুম্ভের মধ্যে সবচেয়ে শুভ হতে চলেছে ২০২৫ সালের এই মহাকুম্ভ। এই চারটি গ্রহ হল সূর্য, চন্দ্র, বৃহস্পতি এবং শনি”।

চলছে ভারতের অন্যতম সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান, মহাকুম্ভ ২০২৫। দেশ-বিদেশ থেকে কোটি কোটি ভক্ত, সাধু, অঘোরি, পুণ্যার্থীরা এসে ভিড় করেছেন উত্তর প্রদেশের ত্রিবেণী সঙ্গম, প্রয়াগরাজে। উদ্দেশ্য প্রধানত একটাই পুণ্য লগ্নে গঙ্গাস্নান করে নিজের সব পাপ ধুয়ে নেওয়া। তবে এই বছরের কুম্ভ অনান্য বছরের তুলনায় একটু অন্যরকম।

জ্যোতিষ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৪৪ বছরে একবার এমন বিরল যোগ আসে। তাই তো এই কুম্ভের নাম ‘মহাকুম্ভ’। কোন বিরল যোগের কারণে এই কুম্ভ মহাকুম্ভ? কত রকমের কুম্ভ হয়? কুম্ভ মেলা কী শুধুই ধর্মীয় অনুষ্ঠান? কী ভাবে ঠিক হয়, কোথায় হবে কুম্ভ? সাধুদের সঙ্গেই বা এই মেলার কী যোগ? কবে শুরু হয়েছিল প্রথম কুম্ভ মেলা?

এই সব প্রশ্ন তুলে ১৪ জানুয়ারি টিভি৯ ডিজিটাল লিখেছে, “কুম্ভ মেলা ঠিক কবে শুরু হয়েছিল তা সঠিক করে বলা সম্ভব নয়। তবে এই মেলা যে কয়েকশো বছরের পুরনো তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অনেকের মতে অষ্টম শতাব্দীতে হিন্দু দার্শনিক ও সাধু আদি শঙ্করাচার্য ভারতজুড়ে মঠ প্রতিষ্ঠা ও ধর্মীয় সমাবেশ করেন। মনে করা হয় সেই সময় তাঁর হাত ধরেই শুরু হয়েছিল কুম্ভ মেলার।

এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে ১৯ শতকের আগে ভারতে এত বড় তীর্থযাত্রার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না, এমনকি সাহিত্যেও উল্লেখ নেই। আবার অনেক প্রাচীন পান্ডুলিপি ও শিলালিপিতে ৬ বা ১২ বছর অন্তর বার্ষিক মাঘ মেলার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেখানে পবিত্র নদী বা কুন্ডে স্নান করার উল্লেখ রয়েছে। যা অনেকটা কুম্ভ মেলার মতোই।

ভারত সংস্কৃতির মহান পণ্ডিত দিলীপ কুমার রায় ১৯৫৪ সালে গিয়েছিলেন কুম্ভমেলায়। এর প্রাচীনত্ব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, শাশ্বত ভারতের আত্মার প্রতীক। তাঁর ‘KUMBH: India’s ageless festival’-তে লিখেছেন, “We do not know exactly when the legend of the Kumbha first became crystallised and began attracting pilgrims but we know that the great Chinese traveller-historian Hieun- Tsang, who came to India in seventh century, witnessed this magnificient religious festival of Prayag, for he left a graphic account of it,….The date of this celebration was 644 AD., so that it can be taken as the first account of the Kumbh-mela, in recorded history”.

আবার ‘ভারতকোষ’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে চিন্তাহরণ চক্রবর্তী লিখেছেন, “কথিত আছে সমুদ্রমন্থনে উত্থিত অমৃতকুম্ভ লইয়া দৈত্যগণের মধ্য হইতে দেবগণ পলায়ণ করিতে থাকিলে উল্লিখিত চারিস্থানে উপরিনির্দিষ্ট সময়ে কুম্ভ রক্ষিত হইয়াছিল বা কুম্ভ হইতে অমৃত ক্ষরিত হইয়াছিল। মেলা অনুষ্ঠানের অন্তরালে সেই ঘটনার পূণ্যস্মৃতি বিরাজমান।”

‘ভারতে কুম্ভমেলা’-তে শাস্ত্রজ্ঞ, সনাতন ধর্মে আস্থাবান সন্ন্যাসী স্বামী বেদানন্দ মহারাজ লিখেছেন, “এই কুম্ভমেলা যে কত প্রাচীন তাহা কেহ বলিতে পারে না। …বোধহয় ভারতীয় আর্যগন যত প্রাচীন, কুম্ভযোগ ও কুম্ভমেলা তত প্রাচীন।” যুক্তিবাদী লেখক তথা বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার নারায়ণ সান্যাল ‘পয়োমুখম’-এ এ সব তত্ত্ব প্রায় উড়িয়ে দিলেও স্বীকার করেছেন, “ঐ কুম্ভমেলা। হাজার হাজার বছর না হলেও নিঃসন্দেহে কয়েক শতাব্দীর।” (এ মুখার্জি অ্যান্ড কোং প্রাঃ লিঃ, প্রথম প্রকাশ, সেপ্টেম্বর ১৯৮৭, পৃ ২১৩)।

১৪ জানুয়ারির টিভি৯ ডিজিটাল এ প্রসঙ্গে জানিয়েছে, “কেন শুরু হল কুম্ভ, জানুন পুরাণ – কুম্ভ মেলা কী ভাবে শুরু হল তা নিয়ে পৌরাণিক ব্যাখ্যা রয়েছে। একবার ঋষি দুর্বাসার অভিশাপে শ্রী হীন হয়ে পরে দেবতারা। ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী আশ্রয় নেন পাতাল লোকে। অন্ধকার ছেয়ে যায় বৈকুন্ঠ লোকেও। এর পরেই ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন দেবতারা। তাঁর পরামর্শে দেবতারা অসুরদের সঙ্গে নিয়ে শুরু করলেন সমুদ্র মন্থন। একের পর এক মূল্যবান হিরে-মানিকের সঙ্গে উঠে আসে কলস ভর্তি অমৃত।

অমৃতর ঘড়া উঠে আসতেই তা দাবি করে বসেন অসুররা। তখন ১২ দিন ধরে সেই ঘড়াকে নিয়ে অসুর এবং দেবতাদের মধ্যে চলে ভীষণ যুদ্ধ। সেই সময় পৃথিবীর চারস্থানে চার ফোঁটা অমৃত পড়ে যায়। সেই সময় চন্দ্র কুম্ভকে ক্ষরণ থেকে, সূর্য কুম্ভ বিস্ফোরণ থেকে, দেবগুরু বৃহস্পতি অসুরদের অপহরণ থেকে এবং শনি দেবেন্দ্রের ভয় থেকে অমৃতের ঘটকে রক্ষা করেছিলেন। শেষে ভগবান বিষ্ণু মোহিনী অবতারে অমৃত বন্টন করে যুদ্ধের অবসান ঘটান। দেব-অসুরের ১২ দিনের যুদ্ধ মনুষ্য লোকে ১২ বছরের সমান। তাই ১২টি কুম্ভ রয়েছে। যার ৪টি (প্রয়াগরাজ, হরিদ্বার, উজ্জয়িনী নাসিক) রয়েছে পৃথিবীতে বাকি ৮ কুম্ভ আছে,দেবলোকে। মনুষ্য লোকের এই ৪ কুম্ভেই গ্রহের অবস্থান দেখে আয়োজন করা হয় কুম্ভ মেলার।

ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় হত মেলা– স্বাধীনতার আগে এই কুম্ভ মেলার আয়োজন করত খোদ ব্রিটিশ সরকার। সেই সময়ে কেবল কুম্ভ মেলার খুঁটিনাটি, সুরক্ষার দিক সব খতিয়ে দেখতে ইংল্যান্ড থেকে জেনারেল পদমর্যাদার অফিসার আসতেন শুধুমাত্র কুম্ভ মেলার আয়োজনের তদারকি করতে।

ক্রমে দেশ স্বাধীন হয়, ১৯৫৪ সালে প্রয়াগরাজেও প্রথম আয়োজন হয়েছিল স্বাধীন ভারতের প্রথম কুম্ভ মেলার। কুম্ভে গিয়ে গঙ্গাস্নান করেছিলেন খোদ জহরলাল নেহেরু, উপস্থিত ছিলেন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদও। সেই বছর সেই কুম্ভ মেলায় অংশ নিয়েছিলেন প্রায় ১২ কোটি মানুষ।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *