শ্রীরূপা চক্রবর্তী, আমাদের ভারত, ৫ জুন: উত্তর ভারতে কিছুটা পিছিয়ে পড়তে পারার আশঙ্কা থেকেই সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গকে এবার টার্গেট করেছিল পদ্ম শিবির। বিজেপির চাণক্য প্রথমে ৩৫ আসন জয়ের লক্ষ্য দেন, পরে সেটা কমে ৩০ হয়। ভোট যত কাছে আসে সেই লক্ষ্য কমে ২৪ এ পৌঁছয়। কিন্তু ২৪ পৌঁছতে যে যে অঙ্ক মোদী–শাহের দল বাংলার জন্য কষেছিল তা একেবারেই মুখ থুবড়ে পড়ল। এককথায় যদি বলা হয় তাহলে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মূলত বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। সেখানে নিয়োগ দুর্নীতি, রেশন দুর্নীতি, সন্দেশখালির মতো তৃণমূলের বিরুদ্ধে থাকা কোনো ইস্যুর দিকেই মানুষ তাকায়নি।
অনেকেই মনে করছেন, দলের অভ্যন্তরে দল বদল করে আসা নেতাদের দাবিকে কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব গুরুত্ব দিয়েছে বেশি। সেই দাবি মেনে কোন প্রার্থী কোন এলাকা থেকে লড়াই করলে ভালো ফল হবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভুল প্রমাণিত হয়েছে দল। এর অন্যতম বড় উদাহরণ দিলীপ ঘোষ। গুঞ্জন এই সিদ্ধান্ত দল বদল করে আসা নেতার মতামতের উপর ভিত্তি করেই হয়েছিল, যা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আর সংবাদ মাধ্যমের আলো সেইসব দল বদলকারি নেতাদের দিকেই বেশি ছিল যারা দলের ভাবনা মানুষের সামনে তুলে ধরার তুলনায় অনেক বেশি ব্যক্তিগত আক্রামণে মেতে থাকত। ফলে দলের ভাবনা মানুষের কাছে পৌছায়নি।
বিশ্লেষকদের একাংশের ধারণা জাতপাতের রাজনীতি বিজেপি ও তৃণমূল উভয় দল করলেও লাভের গুড় কিন্তু শেষ পাতে জোড়া ফুল চেটেপুটে খেয়েছে। কারণ তৃণমূল মুসলিম ভোট পাওয়ার লক্ষ্য পূরণে কার্যত পুরোপুরি সক্ষম। আর বিজেপি সার্বিক ভাবে হিন্দুদের ভোট দখলে আনতে পারেনি। অনেকেই এক্ষেত্রে বলেছেন, সংখ্যালঘু ভোট ধর্মের ভিত্তিতে পাওয়া সহজ হলেও হিন্দু ভোট ধর্মের ভিত্তিতে ঝুলিতে আসে না। এক্ষেত্রে উন্নয়নের মাপ থেকে শুরু করে অনেকগুলো বিষয় চলে আসে। তার মধ্যে অন্যতম বড় বিষয়, বিজেপির হিন্দি কালচারকে জোর করে বাঙালির উপর চাপানোর চেষ্টা। শিব, কালী, কৃষ্ণময় বাংলাকে জোর করে রাম-ময় করার অহেতুক চেষ্টাকে সম্ভবত বাঙালি ভালোভাবে নেয়নি।
আবার সাংগঠনিক ভাবে দেখতে গেলে কেন্দ্রীয় বিজেপির বঙ্গ বিজেপিকে কেবল মনে পড়ে ভোটের সময়। ১৯-র ভোটে যখন বাংলা বিজেপিকে আশীর্বাদ করেছিল, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া মোদীর মন্ত্রিসভায় একখানা পূর্ণমন্ত্রীও জোটেনি। ফলে বাঙালির কাছে বার্তা গেছে, অন্য দলগুলোর মতো কেন্দ্রীয় বিজেপিও বাঙালিকে জাতীয়স্তরে জায়গা দিতে নারাজ। তারাও চায় না বাঙালি নেতা জাতীয় স্তরে উঠে আসুক। সেই কারণেই হাজার দুর্নীতির অভিযোগ বয়ে বেড়ানো অথচ সম্পূর্ণ রূপে বাংলার দলকেই বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে মানুষ। কারণ বার বার দেখা গেছে ভোটের আগে ভোট পাখি হয়ে মোদী–শাহ আসেন, তারপর আর তাদের বাংলার কথা ভাবার সময় থাকে না।
২০১৯ এ ওড়িশায় মাত্র ১২ টি আসন পেয়েছিল বিজেপি। অথচ ওড়িশা থেকে মন্ত্রী ছিল তিনের বেশি। অশ্বিনী বৈষ্ণবের কাঁধে ছিল মোদী মন্ত্রিসভার অন্যতম গুরু দায়িত্ব। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট ওড়িশাকে যেমন গুরুত্ব দিয়েছিল কেন্দ্রীয় বিজেপি তেমন ফল হাতেনাতে পেয়েছে এবার। বলা যেতে পারে কর্নাটক, ওড়িশাই বিজেপি মান রক্ষা করেছে। সেখানে ১৮ টা আসন পাওয়া বাঙলা কেবল মোদী–শাহের মুখের ভাষণে গুরুত্ব পেলেও কাজের ক্ষেত্রে ছিল শূন্য।
অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা আটকে রাখা, নিয়োগ দুর্নীতিতে হাজার হাজার চাকরি চলে যাওয়া আসলে বঙ্গ বিজেপির জন্য বুমেরাং হয়েছে। কারণ গ্রামগঞ্জের মানুষের কাছে রাজ্য সরকার তথা সরকার পক্ষের দল নানা প্রকল্পের অছিলায় খুব সহজেই পৌঁছে যেতে পারে। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের কোনো বিরোধী দলের এখন সাংগঠনিকভাবে সেইভাবে কোমড়ের জোর নেই যে তারা ম্যান টু ম্যান পৌঁছে যেতে পারে। অথচ তৃণমূলের দুর্নীতির কারণে টাকা আটকে গেলেও সেই টাকা তো ছিল গরিব মানুষের টাকা। আর বিজেপি তা বোঝাতে না পারায়, গরিব মানুষ সেই টাকা না পাওয়ার আসল কারণটাই বুঝতে পারেনি। বরং টাকা না পাওয়ার জন্য তৃণমূলের পাল্টা আন্দোলন তারা দেখেছে। ফলে বিজেপির উপর ভরসা তারা করেনি।
আর একটা বিষয় হলো, ভাতার রাজনীতি। যেটার ক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেসকে এক রকম পথ প্রদর্শক বলা যেতে পারে। বিজেপি, সিপিএম সকলেই সেই পথে হাটবে বললেও সঠিক কোনও প্রকল্প তুলে ধরতে পারেনি। বিজেপির কোনো নেতাকে বলতে শোনা গেছে ক্ষমতায় এলে তারা লক্ষ্মীর ভান্ডারে তিন হাজার টাকা দেবেন, কখনো কেউ বলেছেন দুই হাজার, আবার কেউ বলেছেন আরও বেশি। ফলে এই প্রতিশ্রুতি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
সর্বপরি, মারাত্মক মূল্যবৃদ্ধি অন্যতম কারণ হয়েছে এবারের বিজেপির পিছিয়ে পরার জন্য। দৈনন্দিন আকাশ ছোঁয়া দাম, রান্নার গ্যাস, পেট্রোল, জীবনদায়ী ওষুধ, মেডিক্লেম আম আদমির নাভিশ্বাস উঠেছে দৈনিক নূন্যতম খরচ চালাতে। যার প্রভাব পড়েছে ভোট বাক্সে। কারণ এগুলোই ছিল এবার ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম ইস্যু। সেখানে অযোধ্যায় রাম মন্দির, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারার অবলুপ্তির মতো ইস্যু কেবল খাবার টেবিলে আলোচনার বিষয় হয়েই থেকে গেছে, ভোটবাক্সে এর কোনো প্রভাব পরেনি। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে তো নয়ই।
আমি একটি সংগঠনের দিক থেকে বলছি , নাম বংলা পক্ষ | আপনাদের সাথে কথা বলতে চাই | https://amaderbharat.com/is-the-bengal-bjp-only-responsible-for-the-disappointing-results-in-bengal/