তীর্থে তীর্থে পথে পথে, গঙ্গোত্রী ধাম দর্শন (দশম পর্ব)

স্বামী প্রৌঢ়ানন্দ
আমাদের ভারত, ৫ মার্চ: ধীর পায়ে যাত্রা শুরু হল।পাহাড়ের একদিকে গভীর খাদ। একবার কোনও রকমে পা পিছলে পড়ে গেলে আর গঙ্গোত্রী ধাম যেতে হবে না এখানেই গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটবে। ঘন্টাখানেক প্রায় নির্বিঘ্নে হাঁটার পর দেখি রাস্তা বরফের চাঁই পড়ে রাস্তা বন্ধ। ওপারের রাস্তা কোথা থেকে শুরু হয়েছে তাও ঠাঁই করা যাচ্ছে না। এদিকে বরফের অবস্থা যে কিরকম তাও বুঝতে পারছি না, পা দিলে বরফ যদি নরম থাকে তাহলে খাদে পড়ে পঞ্চত্ব প্রাপ্তি নিশ্চিত। দিল্লি থেকে আসা বয়স্ক মানুষ অরুণবাবু বললেন, আর মনে হয় আমরা এগোতে পারব না, কপালে দর্শন না থাকলে আর কি করা যাবে, চলুন ফিরে যাই। আমাদের সকলেরও মন খুব খারাপ, এতদুর এসে ফিরে যেতে হবে, আর কি কোনও দিন এত দূরে আসতে পারব, এজীবনে আর আমাদের গঙ্গোত্রী ধাম দর্শন হল না। এই রকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই আমার কি মনে হল হাতের লাঠি দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে বরফের চূড়ার উপরে উঠতে থাকলাম। অনেকক্ষণের চেষ্টার পরে একেবারে শীর্ষে উঠে এলাম, উঠেই দেখতে পেলাম ওপারের রাস্তা। নীচের সকলকে ইশারা করলাম আমার পায়ের ছাপ লক্ষ্য করে উপরে উঠে আসতে। সকলেই সেই ভাবে উপরে উঠে এলে আমরা পরপর নামতে শুরু করলাম। বরফে পা পিছলে অমরদা একবার পড়ে গেলেন, ভাগ্য ভালো বেশিদূর গড়িয়ে যাননি, তাঁকে সবাই মিলে টেনে তুললাম। ধীরে ধীরে সকলেই নীচে রাস্তার উপরে নেমে এলাম। মনে সকলেরই নতুন আশা, এবার নিশ্চয়ই আমাদের গঙ্গোত্রী ধাম দর্শন হবেই। নতুন উদ্যমে শুরু হল আমাদের পথচলা।

পাহাড়ি রাস্তায় যারা ট্রেক করেছেন তারা জানেন সমতলে হাঁটা আর পাহাড়ি রাস্তার মধ্যে হাঁটার তফাৎ কতখানি।হাঁটতে হাঁটতে আমরা সকলেই গলদঘর্ম। হাতের ঘড়িটিকেও মনে হচ্ছে অসম্ভব ভারী, মনে হয় খুলে ফেলি। নেপালী তীর্থযাত্রীরা আমাদের ছেড়ে এগিয়ে গিয়েছেন। তারা পাহাড়ের দেশের লোক, তাদের সাথে হেঁটে আমরা পারব কেন?

হিমালয়ের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পথ চলেছি। পাহাড়ের যে অংশে সূর্যের আলো পড়ছে না সেই অংশে বেশ ঠান্ডা লাগছে, আবার যে অংশে সূর্যের আলো পড়ছে সেই অংশে যথেষ্ট গরম অনূভত হচ্ছে। চলতে চলতে এবারে একটা পাহাড়ি ঝর্ণা, বহু উপর থেকে প্রবলবেগে নীচে নেমে আসছে, ওটা পেরোতে গেলে ভিজেতো যাবই উপরন্তু জলের তোড়ে খাদে পড়ে যাবারও সম্ভাবনা আছে।কি করা যায়,বসকলে আমরা সেই স্রোতের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইলাম। বেশকিছুক্ষন এই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর নেপালী তীর্থযাত্রী তিনজন একেঅপরের হাত ধরে ঐ স্রোতের মধ্যে প্রবেশ করলেন এবং আমাদেরও তাঁদের হাত ধরতে ইশারা করলেন। এই ভাবে প্রত্যেকে একে অপরের হাত ধরে ঐ ঝর্নার স্রোত অতিক্রম করলাম। পথ যেন আর ফুরোতে চায় না। অনেকক্ষণ পর একটা গ্রাম চোখে পড়ল, রাস্তার ধারে লেখা আছে লঙ্কা। ঘর সব খালি, এখানকার বাসিন্দারা এখন সবাই নীচে আছেন, রাস্তা পরিষ্কার হলে, গাড়ি চলাচল শুরু হলে তারা আবার উপরে উঠে আসবেন।এখানে চুরির কোনও ভয় নেই, তাই ঘর দোর, দোকান পাট কেউ তালাচাবি লাগিয়ে যাননি, আমাদের মতন অসময়ের পথিক যদি কেউ এখানে চলে আসেন তাহলে তারাও এখানে আশ্রয় নিতে পারেন। লঙ্কা ছেড়ে এগিয়ে চললাম।কিছুটা এগনোর পর চোখে পড়ল একটা মিলিটারি ছাউনি।

আমাদের দূর থেকে দেখতে পেয়ে তাঁরা কয়েকজন এগিয়ে এলেন। তঁদের ছাউনিতে নিয়ে গিয়ে আমাদের সকলের নাম, কোথা থেকে আসছি ইত্যাদি জানতে চাইলেন। আমরা আমাদের কথা সবিস্তারে জানালাম। শুনে খুব খুশী হলেন।বললেন, আপনারা এই বছরে এই ধামের প্রথম তীর্থযাত্রী, এগিয়ে যান কোনও ভয় নেই। তাঁরা আমাদের সকলকে চা খাওয়ালেন। অপূর্ব সে চায়ের স্বাদ, খাবার পর দেহে নতুন বলের সঞ্চার হল। তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার আমরা এগিয়ে চললাম।

নেপালী তীর্থযাত্রীরা আমাদের ছেড়ে আবার এগিয়ে গিয়েছিলেন। এখন দেখতে পাচ্ছি তারা নদীর ধারে বসে কি যেন একটা করছেন।ভসামনে গিয়ে দেখি তারা আগুন জ্বালিয়ে আটা আর আলু পোড়াচ্ছেন। আমাদেরও বসে যেতে বললেন, বসে পড়লাম। লঙ্কা সহযোগে সেই আটাপোড়া আর আলুপোড়া যে এত সুস্বাদু হতে পারে আমার ধারনা ছিল না।

যতই আমাদের লক্ষ্য সামনে আসছে ততই যেন ভগবান আমাদের সহিষ্ণুতার পরীক্ষা নিচ্ছেন, দু’পা হাঁটতে গেলেই হাঁপ ধরে যাচ্ছে, বুক হাপরের মতন ওঠানামা করছে। ক্লান্ত শ্রান্ত দেহগুলোকে নিয়ে কোনও রকমে এগিয়ে চলেছি।পায়ের তলায় প্রায় প্রত্যেকেরই ফস্কা পড়ে গেছে। প্রতিটি পদক্ষেপে পা জানান দিচ্ছে তার এবার বিশ্রাম চাই,বকিন্তু থামলে চলবে না, লক্ষ্য পুরন না হওয়া পর্যন্ত আমরা চলতে থাকব, আমাদের মন্ত্র চরৈবতি। পথের ধারে একটা মাইল ফলকে দেখলাম গঙ্গোত্রীধাম এক কিলোমিটার।

কিছুটা এগোনোর পর চোখে পড়ল এক সাধুবাবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছেন। কঙ্কাল সার চেহারা, হাঁড়গুলি যেন গোনা যাচ্ছে, কৌপিন মাত্র সম্বল আর সারা গায়ে ভস্মের প্রলেপ। গিয়ে প্রনাম করতেই সামান্য হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন। জিজ্ঞাসা করলাম বাবা আপনি এত ঠান্ডায় এই জনমানবহীন প্রান্তরে কী করে আছেন? এখানে থাকেনই বা কোথায় আর খাবারই বা জোটে কিভাবে? জবাবে সাধুবাবা শুধু মাগঙ্গার উদ্দেশ্যে আঙুল দেখালেন। বুঝতে পারলাম ইনি মৌনব্রত অবলম্বন করে আছেন আর অঙ্গুলি নির্দেশ করে বোঝাতে চাইলেন মা গঙ্গাই তাঁর খাবার জুটিয়ে দেন। আমরা অবাক হয়ে গেলাম আশেপাশে কোনও কুটিরও চোখে পড়ছে না যেখানে উনি থাকতে পারেন। এই ঠান্ডায় যেখানে রাতের তাপমাত্রা মাইনাসে নেমে যায় সেখানে এই রকম খালি গায়ে উনি থাকেন কীভাবে! পুনরায় তাঁকে প্রনাম করে আমরা গঙ্গোত্রী ধামের দিকে রওনা হলাম, উনি হাত তুলে আমাদের অভয়াশীষ দিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *