অশোক সেনগুপ্ত, আমাদের ভারত, ২৮ মার্চ: ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড অ্যাক্রেডিটেশন (ন্যাক)-এর প্রস্তুতি চলছে বিভিন্ন কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গ এদিক থেকে পিছিয়ে পড়েছে লক্ষ্যণীয়ভাবে। পরিস্থিতি খতিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডঃ সুকান্ত মজুমদার, দলের নেতা অমিত মালব্য প্রমুখ।
অমিতবাবু জানিয়েছেন, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধীনে পশ্চিমবঙ্গে উচ্চশিক্ষার এই অবস্থা—১,০০০-এরও বেশি কলেজে জাতীয় মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি পরিষদের (‘ন্যাক’) স্বীকৃতি নেই। পশ্চিমবঙ্গে ১,৫১৪টি কলেজ এবং ৫৮টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, তবুও মাত্র ৫১৪টি কলেজ এবং ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় ‘ন্যাক’ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছে। উদ্বেগজনকভাবে, এর অর্থ হল ১,০০০টিরও বেশি কলেজ এবং ৩৮টি বিশ্ববিদ্যালয় ‘ন্যাক’ স্বীকৃতি ছাড়াই কাজ করছে। এটি রাজ্যে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ তৈরি করছে।”
একই রকম চিন্তা ডঃ সুকান্ত মজুমদারের। কিন্তু এদিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের অনগ্রসরতার তথ্যটা কিরকম? ‘ন্যাক’-এর সর্বশেষ তথ্য বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় মিলিয়ে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেশে সবচেয়ে বেশি মহারাষ্ট্রে, মোট ২,৬১৯। কর্ণাটকে ১,১১৪। তামিলনাডুতে ১,০২৬। মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক ও তামিলনাডুতে ন্যাক-তকমাপ্রাপ্ত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা যথাক্রমে ৩৮ ও ২ হাজার ৫৮১, ৪৪ ও ১ হাজার ০৭০ এবং ৪৬ ও ৯৮০। এর পরে এই তালিকায় যথাক্রমে উত্তর প্রদেশ, গুজরাত, অন্ধ্রপ্রদেশ। তার পরে পশ্চিমবঙ্গ ১৯ ও ৪৮২, মোট ৫০১।
কেন এ রকম হচ্ছে? চন্দননগর কলেজ শিক্ষা সংসদের সভাপতি রূপন পাঁজার মতে, ‘ন্যাক’ পদ্ধতিতে কিছু কিছু প্রতিবন্ধকতা আসছে। সেগুলোর কয়েকটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। যেমন-
১) ন্যাক এ বাধ্যতামূলকভাবে ‘অ্যাড অন’ পাঠ্যক্রমের কথা বলা আছে। কিন্তু এতে টাইম ম্যানেজমেন্টের সমস্যা হয়। কারণ স্নাতকস্তরে CCFUP (Curriculum and Credit Framework for Undergraduate Programmes)-তে এ ইন্টার্নশিপ বা শিক্ষানবীশি বাধ্যতামূলক রয়েছে। এর লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের কাজের সক্ষমতা (এমপ্লয়াবিলিটি) বাড়ানো। ‘অ্যাড অন’ এর উদ্দেশ্যও তাই। একই উদ্দেশ্যে দু’টি পাঠ্যক্রম সূচীতে এত জায়গা নিচ্ছে ফলে শিক্ষার্থীদের মূল বিষয়ক অনার্স ক্লাসের সংখ্যা কমছে।
২) বিগত অর্ধ দশক ধরে দেখা যাচ্ছে যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) শিক্ষকদের গবেষণা বিষয়ক প্রকল্প দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষককুলের গবেষণা প্রোফাইল। সে কারণে কমে গিয়েছে কলেজের ‘ন্যাক’ নম্বর।
৩) ইউজিসি গত ১০ বছরে বিভিন্ন সময়ে তাদের জার্নালের তালিকা বদলেছে। এখন অনেক বিষয়ের জার্নাল, তালিকায় যথেষ্ট সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত নেই। নতুন জার্নাল অন্তর্ভুক্ত করার পদ্ধতি সময়সাপেক্ষ ও জটিল। এর ফলে ‘ন্যাক’-এ গবেষণাপত্র সংক্রান্ত পয়েন্ট তুলতে বেগ পেতে হয়েছে কলেজকে। বিভিন্ন শিক্ষক- শিক্ষিকা ‘পিয়ার রিভিউ জার্নালে’ প্রকাশ করেছেন, যেগুলি কলেজ ‘ন্যাক’-এ তার ভিত্তিতে নম্বর পায়নি।
৪) ‘ন্যাক’-এ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তহবিলের সদব্যবহার করে পরিকাঠামো উন্নয়ন। এর উপর একটি বড় নম্বর থাকে ‘ন্যাক’ মূল্যায়নে। আমরা জানি, সংবিধানে শিক্ষা কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় লিস্টের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বিগত বহু বছর ইউজিসি-র পরিকল্পনাভিত্তিক টাকা দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। অতীতে ইউজিসি-র একাদশ, দ্বাদশ পরিকল্পনার টাকায় কলেজের কাঠামো উন্নয়ন ও মেরামত সম্ভব হয়েছিল। শিক্ষার্থীরা লাভবান হয়েছিল। কিন্তু শেষ বহু বছর ইউজিসি-র এই রকম অর্থ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে কলেজ সামগ্রিক সমস্যাতে পড়েছে।” এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের উচ্চমাত্রায় শিক্ষাখাতে বরাদ্দ, নতুন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা, সেগুলিকে উন্নত করার মাধ্যমে সুফল মিলেছে বলে দাবি রাজ্যের শিক্ষাবিদদের একাংশের।
রূপন পাঁজার এই যুক্তির পরেও প্রশ্ন উঠেছে, এমন তো নয় কেবল পশ্চিমবঙ্গের জন্য ইউজিসি কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে। তাহলে অন্য কিছু রাজ্য কীভাবে ভাল ফল করছে? পশ্চিমবঙ্গ অধ্যক্ষ পরিষদের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক শ্যামলেন্দু চট্টোপাধ্যায় জানান, এখানকার বহু কলেজে অধ্যক্ষ নেই। টিআইসি দিয়ে চালানো হচ্ছে। এই কারণে সংশ্লিষ্ট কলেজ অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ঠ উদ্যোগী হচ্ছে না। এরকম একটি প্রতিষ্ঠান কলকাতার কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলের চিত্তরঞ্জন কলেজ। পরিকাঠামোর অপ্রতুলতায় এতকাল ‘ন্যাক’ করানো হয়নি।
শ্যামলেন্দু চট্টোপাধ্যায় জানান, গতবার ‘ন্যাক’-পরিদর্শন কমিটি চিত্তরঞ্জন কলেজে এসে বলে গিয়েছিল অবিলম্বে নতুন কলেজভবনের ব্যবস্থা করতে। এরা সেটা করতে পারেনি। ফলে, মূল্যায়ণ ভালো হয়নি। এবার কলেজটি ‘ন্যাক’-এর মূল্যায়ণে ‘সি’ পেয়েছে। আবার দ্রুততার সঙ্গে বাড়তি স্থান সঙ্কুলানের ব্যবস্থা করে ‘ন্যাক’-এর মূল্যায়ণে ভালো ফল করেছে বঙ্গবাসী কলেজ।
গঙ্গা তীরে অবস্থিত ফরাসী ঐতিহ্য সম্পন্ন চন্দননগর কলেজে প্রথমবার ‘ন্যাক’ মূলায়ন হয় ২০০৯ সালে (প্রথম চক্র) এবং পরবর্তী (দ্বিতীয় চক্রের ) ‘ন্যাক’ মূল্যায়ন হয় ২০১৬ সালে। অতি সম্প্রতি ২০২৪ সালে তৃতীয় চক্রের ‘ন্যাক’ মূল্যায়ন হয়েছে কলেজে। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে কলেজ ‘এ++’ তকমা পায়। সূত্রের খবর, এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত নথি তৈরি করতে গিয়ে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে কলেজকে।
অমিত মালব্যর মতে, “অ্যাকাডেমিক উৎকর্ষতা নিশ্চিত করতে, তহবিল নিশ্চিত করতে এবং শিক্ষার্থীদের সুযোগ বৃদ্ধির জন্য ‘ন্যাক’-এর স্বীকৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠানগুলিকে সহায়তা করার জন্য, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সরকারি কলেজগুলির জন্য ‘ন্যাক’-এর ফি মকুব করছে। স্বীকৃতি প্রক্রিয়ায় সহায়তা করার জন্য বিশেষ কর্মশালার ব্যবস্থা করেছে। তা সত্ত্বেও, কেন এত প্রতিষ্ঠান এখনও অনুমোদনহীন? শিক্ষার্থীরা আরও ভালো সুযোগ পাওয়ার যোগ্য। আমরা রাজ্য সরকার এবং শিক্ষা কর্তৃপক্ষকে শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাই।”