বসন্ত উৎসবে রবীন্দ্রভারতীতে ছাত্রছাত্রীদের পিঠে-বুকে আপত্তিকর অশ্লীল শব্দে তুঙ্গে সংস্কৃতি বিতর্ক!

সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা ৬ মার্চ: বজ্র আঁটুনিতেও ফস্কা গেরোর ধাক্কা এড়াতে পারল না রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিটি রোড ক্যাম্পাস। গত বছর বহিরাগত কিছু মদ্যপ পড়ুয়াদের বসন্ত উৎসবের ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়া নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। এবারে পাস এবং প্রবল নিরাপত্তা সত্ত্বেও অপসংস্কৃতিতে কলঙ্কে কলঙ্কিত হল রবীন্দ্র চর্চার পীঠস্থান রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। বৃহস্পতিবার দোল উৎসবের কিছু অশ্লীল ছবি ঘিরে প্রবল বিতর্ক তৈরি হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।

ছবিগুলিতে দেখা গিয়েছে, শাড়ি পরা কয়েক জন তরুণীর পিঠে আবির দিয়ে আপত্তিকর ও অশ্লীল শব্দ লেখা রয়েছে। যা রবীন্দ্রনাথের একটি গানের লাইনের অশ্লীল ব্যাখ্যা।আপত্তিকর শব্দ লেখা রয়েছে ছেলেদের বুকেও। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি, বিতর্কিত ছবিগুলিতে যে মেয়ে ও ছেলেদের দেখা যাচ্ছে তারা কেউ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া নয়।

গতবারের সমস্যা বিবেচনা করে এ বছরই প্রথম পাস দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা হয়। অর্থাৎ পাস ছাড়া কেউই রবীন্দ্রভারতীর বসন্ত উৎসবে যোগ দিতে পারবেন না। শুধু তাই নয়, বিটি রোড ক্যাম্পাসের বসন্ত উৎসবকে কেন্দ্র করে চারিদিকে সিসিটিভি লাগানোর পাশাপাশি প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে খবর, প্রায় ৫০ হাজার পাস ছাপা হয় বসন্ত উৎসবের জন্য। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি অন্যান্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের জন্য এই পাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকেই এই ছবিগুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট হওয়ার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ খোঁজ নিতে শুরু করে। পরে সিঁথি থানায় কর্তৃপক্ষের তরফে এই নিয়ে অভিযোগও জানানো হয়। ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।

এই ব্যাপারে উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি স্বীকার করে নেন, এই ঘটনা ক্যাম্পাসেই ঘটেছে। তবে সেই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, দোল উৎসব উপলক্ষে ক্যাম্পাসে প্রচুর বহিরাগত এসেছিলেন। তাই কারা এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন, তা চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব। তবে পুলিশের সাহায্য নিয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে।

রবি ঠাকুরের গানের কথা বিকৃত করে তা পিঠে লেখা থেকে শুরু করে সেই বিকৃত গানে নাচ, দুটোই সমানতালে হয়েছে এবারে রবীন্দ্রভারতী বিটি রোড ক্যাম্পাসের বসন্ত উৎসবে। এ দিকে এই ‘অপসংস্কৃতির’ কড়া সমালোচনায় সরব হয়েছেন রুচিশীল সমাজের নাগরিকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীরা আবার একে সোজা ‘বেলেল্লাপনা’ বলেই আখ্যা দিয়েছেন। বাঙালি জাতি নিজেদের সংস্কৃতি সম্বন্ধে আত্মিক হলে এমন ঘটনা কখনই ঘটত না বলেও মত প্রকাশ করেছেন অনেকে।


(অভিযুক্ত ছাত্রছাত্রী)

প্রসঙ্গত রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় বসন্ত উৎসব প্রত্যেক বছরই খুব মনোরম ভাবে আয়োজন হয়ে থাকে আর তা দেখার জন্য বহিরাগত মানুষ চিত্রগ্রাহক থেকে শুরু করে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আসেন। কিন্তু বরাবর প্রবেশ অবাধ থাকার সুযোগে বেশ কয়েক বছর ধরেই গন্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করছেন কিছু বহিরাগতরা। সেই কারণেই সিসিটিভি সহ নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি এ বছর থেকে ‘আমন্ত্রণের ভিত্তিতে’ পাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। যদিও সেই আমন্ত্রণপত্র জোগাড় করা অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের থেকে নিয়ে নেওয়া এমন কোনও কঠিন বিষয় নয়। আর এই ধরনের পাশে কারোর নাম লেখা নেই। ফলে এবারও বিশৃঙ্খলা করার সুযোগ পেয়েছে বহিরাগতরা।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রাক্তনীদের দাবি, রবীন্দ্রভারতী চত্বরে বসন্ত উৎসবের পর সেখান থেকে এমন কিছু ছবি ও ভিডিও উঠে এল যা বাঙালি হিসেবে মাথা হেঁট করিয়ে দেয়। গতকাল সন্ধে থেকেই একটি ছবি দাবানলের গতিতে ভাইরাল হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। যেখানে দেখা যায় চারজন তরুণী নিজেদের পিঠে রবি ঠাকুরের গানের বিকৃত কথা লিখেছেন। ‘সেই’ কথা যা সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে রোদ্দুর রায় নামক এক ব্যক্তির মুখ থেকে। ছবিটি ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই নিন্দার ঝড় ওঠে রবীন্দ্র অনুরাগীদের মধ্যে। সাধারণ চিন্তাশীল ও বুদ্ধিজীবী সমাজও নিন্দায় সরব হয়।

রাত হতে হতে আবার একটি ভিডিও ভাইরাল হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। যেখানে একদল ছেলেমেয়েকে দেখা যায় রোদ্দুর রায়ের সেই বিকৃত গানে উন্মত্তভাবে নাচতে। যা দেখার পর এক প্রাক্তনীকে বলতে শোনা যায়, ‘লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে। এই রবীন্দ্রভারতী আমার অচেনা।’

গানের অশ্লীল কথন সৃষ্টিকারী রোদ্দুর রায় নামের ওই ব্যক্তির গ্রেফতারের দাবি তোলেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী বাদে যেসব বহিরাগতরা এদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নেশাগ্রস্ত ছিলেন বলেও দাবি করা হচ্ছে। ফলে বিষয়টি নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই প্রবল চাপে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে ঘটনাটি নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছে পুলিশ।

এদিকে চাপের মুখে পড়ে শুক্রবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন অভিযুক্ত পাঁচ ছাত্র-ছাত্রী। জানা দিয়েছে, তাঁরা হুগলির শ্রীরামপুর ও চন্দননগরের বাসিন্দা। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর তাঁদের নিরাপত্তারক্ষীদের ঘরে বসিয়ে রাখা হয়। সেখানে আসেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা। তাঁদের সামনেই হাতজোড় করে দোষ কবুল করে নেয় ভুল স্বীকার করেন ওই পাঁচ ছাত্র-ছাত্রী। যদিও তাদের ক্ষমা করা উচিত হবে কি না, তা নিয়ে আইনি পরামর্শ নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই ঘটনায় রবীন্দ্র ভাবাদর্শে এবং বাঙালির আত্মসম্মানে যে কলঙ্কের ছিটে লাগল, সেটা বোধহয় কোনদিনই মুছবে না, এমনটাই মত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *