Bengali বহির্বঙ্গে বাঙালি, বাংলা চর্চা

অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, ২১ ফেব্রুয়ারি: *যুগান্তরের সাথে সাথে কি ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে বাঙালিয়ানা? দুর্বল হয়ে পড়ছে বাংলা ভাষার গুরুত্ব? আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসে এ নিয়ে কথা হল বহির্বঙ্গের কিছু বঙ্গসন্তানের সঙ্গে।*


সুনির্মল দাশ (পটনা)
বিহার বাঙালি সমিতির প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক, সমিতির মুখপত্র ‘সঞ্চিতা’ পত্রিকার সম্পাদক। বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা সমিতি, নন্দন কানন, কর্মাটাঁড়, জেলা জামতাড়া, ঝাড়খণ্ড-র প্রাক্তন সম্পাদক সুনির্মল দাশ। জন্ম ১৪.০৪.১৯৫৬, পটনাতে। বাবা কাজ করতেন এলআইসি-তে। আদি বাড়ি মুর্শিদাবাদ ব্লকের বেওয়া গ্রামে। সুনির্মলবাবু ৬৮ বছর ধরে আছেন পটনায়। কাজ করতেন এএন সিনহা ইন্সটিট্যুট অফ সোস্যাল স্টাডিজ-এ।

সুনির্মলবাবুর দুই ছেলে— অয়ন ও সায়ন। বড় ছেলে আর্কিটেক্ট, এখন কলকাতায় নিজের ব্যবসা শুরু করেছে। ছোট ছেলে এমবিবিএস, চিকিৎসক। যেহেতু ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ত, সেখানে বাংলা পড়ানোর সুবিধা ছিল না। তবে বাড়িতে বাংলা শিখিয়ে ছিলেন। এখনও বাংলা পড়তে পারে।

সুনির্মলবাবু জানান, “পশ্চিমবঙ্গে ঘনিষ্ঠদের কাছে আসার সুযোগ হয় ভালই। প্রায়ই গ্রামে যাই।” বাঙালিয়ানা/বাংলা ভাষা এগুলোর চর্চা/শেখার কোনও অবকাশ ওখানকার প্রবাসীদের মধ্যে আছে কি? উত্তরে বলেন, “আমরা নিজেদের প্রাবাসী মনে করিনা বা বলিনা। আমরা বিহারবাসী বাঙালি। আমি মাট্রিকে বাংলা ভাষায় পরীক্ষা দিয়েছি। ইন্টামিডিয়েটেও বাংলা ভাষার ৫০ নম্বরের পরীক্ষা দিয়েছি।”

সুনির্মলবাবু জানান, “বিহারের বেতিয়া, পূর্ণিয়া ও বেশ কয়েকটি জেলায় প্রাথমিক স্কুলে বাংলা ভাষার শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে ও হচ্ছে। বাংলা বই আছে, তবে সরকার ছাপানোর ব্যবস্থা করেনি। তা নিয়ে বিহার বাঙালি সমিতি চেষ্টা করে চলেছে। বিহার বাঙালি সমিতি ধরনা, প্রদর্শন, হাইকোর্টে মামলা করে বাংলা ভাষার জন্য লড়ে চলেছে। সরকার মান্যতা দেয়, এই সংগঠনকে। বিহারে বাংলা ভাষা সরকারি মান্যতা প্রাপ্ত একটি সংখ্যালঘু ভাষা। ভারতের প্রথম বাঙলা আকাডেমি বিহারের হয়েছে।”

গত পঁচিশ বছরে সমিতির সদস্য সংখ্যা কতটা বদলেছে? সুনির্মলবাবুর উত্তর, “পঁচিশ বছর আগে সমিতির সদস্য সংখ্যা ঠিক বলা যাবে না। বর্তমানে আনুমানিক ৬-৭ হাজার হবে।
সারা ভারতে একমাত্র সংগঠন, যাদের বিহারের প্রতিটি মুখ্য জেলায় সমিতির সক্রিয় শাখা আছে। তারা ১৯৩৮ সাল থেকে মাতৃভাষা বাংলার জন্য সংগঠিত ভাবে ভারতের সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ব পালন করে চলেছে। মাঝে কিছু বছর সমিতি নিষ্ক্রিয় থাকার পর ১৯৬৫ সাল থেকে আজ পর্যন্ত সক্রিয় আছে। সমিতির ওয়েবসাইট babihar1938.in”
***


সন্দীপ বিশ্বাস (আগরতলা)
জন্ম আগরতলায়, ১৯৮৩ সালে। মাঝে পাঁচ বছর উচ্চ শিক্ষার জন্য ত্রিপুরার বাইরে ছিলেন। বাবা ১৯ বছর বয়স থেকে আগরতলায় রয়েছেন। ত্রিপুরার ধলাই জেলায় কুলাইতে জন্মেছেন। ১৯৫৪ সালে তাঁর হাত ধরে ত্রিপুরার প্রথম বাংলা সংবাদপত্র আত্মপ্রকাশ করে। এখন তাঁর বয়স ৭৩। ওই পত্রিকাটাই দেখাশোনা করেন সন্দীপ।

প্রশ্নের উত্তরে সন্দীপ এই প্রতিবেদককে জানান, ত্রিপুরায় সরকারি নিবন্ধিকৃত বাংলা পত্রিকা রয়েছে ষাটের অধিক। আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। পুজো, নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। নবীন প্রজন্মের বাংলা শেখার অবকাশ প্রচুর। কিন্তু, আগ্রহ সেই তুলনায় অনেক কম।

ত্রিপুরায় বাংলা মাধ্যমের স্কুলের চাহিদা প্রসঙ্গে তিনি জানান, “বিষয়টি আপেক্ষিক। কারণ, সরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা কম হওয়ায় অনেকই বাংলা মাধ্যমে বাধ্য হয়ে ভর্তি হচ্ছে। তবে পুত্র সৌহার্দ্য ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।” পশ্চিমবঙ্গে যাতায়ত প্রসঙ্গে তিনি জানান, “পশ্চিমবঙ্গে আমার আত্মীয় রয়েছেন। কাজের সূত্রেই কলকাতায় যাওয়া বা যোগাযোগ হয়। তবে, সেটা খুবই কম।”

ত্রিপুরার বাঙালিদের ওপর কথাবার্তা, আগ্রহ, ভাবনা— এসবে ওপার বাংলা না এপার, কোন বাংলার প্রভাব বেশি? সন্দীপের উত্তর, “পুরোটাই ওপার বাংলার প্রভাব। এপার বাংলার প্রভাব নেই।”
***


বিদ্যুৎ ব্যানার্জি (ভাগলপুর)
বহির্বঙ্গে দীর্ঘকাল কাটিয়ে চলে এসেছেন। ব্যানার্জি পরিবারের পাঁচ ভাইবোন ’২২-এর অক্টোবরে পশ্চিমবঙ্গ থেকে গিয়েছিলেন ভাগলপুরে। মানসিকভাবে ধাক্কা খেতে হল। অনেকটাই অন্তর্হিত বাংলা ভাষার প্রভাব, বাঙালিয়ানা। স্কুলে বাংলা ভাষা অবশ্য এখনও আছে।

বাংলা ভাষা এবং বাঙালিয়ানার পরিবর্তন তাঁদের চোখে কতটা ধরা পড়েছে, তা বুঝতে যোগাযোগ করেছিলাম ‘বিহার বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন’-এর সদস্য, ‘আমাদের ভাগলপুর’-এর অন্যতম কর্মকর্তা বিদ্যুৎ ব্যানার্জির সঙ্গে। ১৯৬০ থেকে ’৮৪ তিনি ছিলেন ভাগলপুরে। এর পর এসবিআইয়ের আধিকারিক হিসাবে ১৬ বছর ম্যাসাঞ্জোর-সংলগ্ন রানিশ্বরে। আগে ওই অঞ্চল ছিল বিহারে। এখন ঝাড়খণ্ডে। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশি রাজ্যে বাংলা ভাষার প্রচলন ও গুরুত্বের পরিবর্তনের চালচিত্রটা অনুভব করেছেন ভালোভাবে।


বিদ্যুৎবাবুর কথায়, “ভাগলপুরে চার্চ মিশনারি সোসাইটির স্কুলে আমরা তিন খুদে বাঙালি ছিলাম। দু’জনের প্রথম ভাষা ছিল হিন্দি। আমার ছিল বাংলা। ছেলেকেও বাংলা শিখিয়েছিলাম। কর্মসূত্রে ও এখন মেলবোর্নে। বাঙালিদের প্রতিষ্ঠিত দুর্গাচরণ হাইস্কুল, মোক্ষদা হাইস্কুল এখনও আছে। দিদি পড়ত সুন্দরবতী মহিলা কলেজে। আগে ছিলেন বাঙালি অধ্যক্ষা। ’২২-এ গিয়ে দেখলেন দায়িত্বে হিন্দিভাষী একজন।

বাংলা ভাষা, বাঙালিআনার কী দারুণ জায়গা ছিল ভাগলপুর! শরৎচন্দ্রের বাবা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন বলে শরৎ চন্দ্রের শৈশবের অধিকাংশ সময় এই শহরেই কেটেছিল। শরৎচন্দ্রের সেই মামার বাড়ি ছিল বাঙালি নক্ষত্রদের আড্ডাস্থল। এখনও সেই বাড়ি আছে। তবে উজ্জ্বল নক্ষত্রদের বাংলাচর্চার আসর বসে না।


এই প্রতিবেদককে বিদ্যুৎবাবু জানালেন, “১৯৭৫-এ শরৎ শতবার্ষিকীতে কত নামী বাঙালি কবি-লেখক এসেছিলেন। বনফুল ওখানেই থাকতেন। তাঁকে চোখের সামনে দেখেছি। কিশোরকুমারদের মামার বাড়িও ছিল এই শহরে। বলিউডের দাদামণি অশোককুমারের বিয়ে হয়েছিল ভাগলপুরে। গঙ্গার ধার ঘেঁষে অনেকটা অংশ জুড়ে ছিল বাঙালিদের বাড়ি। সেগুলোর ৬০ শতাংশের ওপর বিক্রি হয়ে গেছে। বাকিদের পরিবারের সদস্যরা আছেন। তবে, যুগান্তরের সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবেই বদলে গেছে বাঙালিয়ানা, বাংলা চর্চার ঘরানা।”

বিদ্যুৎবাবুর কথায়, একটা দীর্ঘ সময় ধরে বাঙালিরা এখানে প্রভাবশালী ছিলেন। প্রভাব ছিল বাংলা ভাষারও। এখন সেসবের গুরুত্ব আগের চেয়ে কমেছে। বাঙালিদের পুজো, অনুষ্ঠান হয়। গ্রন্থাগার আছে। কিন্তু ভাষার প্রসার কীভাবে হবে? হিন্দি ছড়িয়েছে বেশি। আর, বাঙালিয়ানা ও বাংলা ভাষা তো ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে খাস কলকাতাতেই! বিয়েতে মেহেন্দি, বাজনা বাজানোর মত উত্তর ভারতীয় আচার ঢুকে পড়েছে। ‘গায়ে হলুদ’-এর অনুষ্ঠানকে বলি হলদি! অর্ধেক কথায় মাতৃভাষা বর্জন করি। বহির্বঙ্গেই বা কিভাবে বিকশিত হবে বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতি?
***

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *