অশোক সেনগুপ্ত, আমাদের ভারত, ১০ মার্চ: শেষ পর্যন্ত ভাইপোর এই জেদটা অন্তত রাখতেই হল পিসিকে। দলে নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্বে তথাকথিত প্রবীণরা নিজেদের সমর্পন করেছিলেন তৃণমূল নেত্রীর কাছে। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায়ের মত প্রবীণরা প্রার্থী হলেও টিকিট পেলেন না ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিং। অর্জুনবাবুর বদলে ওই কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী হলেন অভিষেকের অন্যতম ঘনিষ্ঠ এবং স্থানীয় রাজনৈতিক মহলে কট্টর অর্জুন-বিরোধী বলে পরিচিত পার্থ ভৌমিক।
২০১৯-এর লোকসভা ভোটে তৃণমূল টিকিট না পেয়ে বিজেপির প্রার্থী হয়েছিলেন অর্জুনবাবু। তৃণমূলের চ্যালেঞ্জ এবং ওই সংসদীয় কেন্দ্রে মমতা-অভিষেকের গোটা ছয় সমাবেশ সত্বেও সেবারের তৃণমূল প্রার্থী তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীকে পরাজিত করেন ১৪ হাজার ৮৫৭ ভোটে। কিন্তু অনেকটা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায়, মেয়াদের প্রায় মাঝপর্বেই, একুশের বিধানসভা নির্বাচনের পরেই বিজেপি ছেড়ে অর্জুনবাবুকে চলে আসতে হয় তৃণমূলে।
অর্জুনবাবু এবারেও প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। সূত্রের খবর, প্রাথমিক সবুজ সঙ্কেতও পেয়েছিলেন দলনেত্রীর কাছ থেকে। কিন্তু ক্রমেই রাজ্যের সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিক, হালিশহর পৌরসভার চেয়ারম্যান সুবোধ অধিকারী, জগদ্দলের তৃণমূল বিধায়ক সোমনাথ শ্যাম প্রমুখ আদাজল খেয়ে অর্জুনবাবুর বিরোধিতায় নামেন।
কয়েক মাস আগে ব্যারাকপুর কোর্টের আইজনজীবীর সেরেস্তায় বসে অর্জুনবাবু মন্তব্য করেছিলেন, “আমি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আবেদন করব, যাতে ওঁর (সোমনাথের) নিরাপত্তা তুলে নেওয়া হয়।” কিন্তু সাংসদ অর্জুন সিংহের সেই মন্তব্যের পক্ষকাল কাটার আগে উল্টো ঘটনাই ঘটে। নবান্ন নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে সোমনাথের।
লোকসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসছিল, ততই অর্জুনবাবুকে নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছিল তৃণমূলের অন্দরে। দলেরই এক নেতা অর্জুনকে প্রার্থী না করার আবেদন জানান তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে। ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে যাতে অর্জুন সিং-কে টিকিট দেওয়া না হয়, এর জন্য সাধারণ মানুষের সই সংগ্রহ শুরু করেন সোমনাথ শ্যাম।
সাংবাদিক সম্মেলন করে সোমনাথবাবু বলেন,’ব্যারাকপুর লোকসভার সাধারণ মানুষের এবং এখানকার তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীদের একটি দাবি এসেছে যাতে যারা ২০১৯ সালে মানুষের ওপরে অত্যাচার করেছিল, সেই অশুভ শক্তিদের যাতে কোনওরকম স্থান না দেওয়া হয়। ব্যারাকপুর লোকসভার সেই দাবি মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিয়েছি আমরা। এবার দলনেত্রী যা সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই আমরা মাথা পেতে নেব।’
সোমনাথ শ্যামের দাবি, ব্যারাকপুরের ‘বাহুবলী’ সাংসদ অর্জুন সিং-কে নিয়ে দলের বাকি নেতৃত্বকেও ক্ষোভের মুখে পড়তে হচ্ছে। অর্জুনবাবুর বিরুদ্ধে ব্যারাকপুরের বিধায়ক রাজ চক্রবর্তী, বীজপুরের বিধায়ক সুবোধ অধিকারী, নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিকের কাছেও চিঠি আসছে বলে দাবি করেন তিনি। সোমনাথবাবুর দাবি, ব্যারাকপুরের সাধারণ মানুষ, দলের নেতা কর্মীরাই এই দাবি জানাচ্ছেন।
রবিবার তৃণমূলের জনগর্জন সভাতে উপস্থিত ছিলেন অর্জুন। বিজেপি থেকে তৃণমূলে আসা ৫ জন প্রার্থী হয়েছেন। প্রার্থী তালিকায় নাম নেই অর্জুন সিংয়ের। যদিও প্রার্থী তালিকায় তাঁর নাম নেই দেখেই আগেভাগেই তিনি সভাস্থল ছাড়েন। সূত্রের খবর, টিকিট না পেয়ে নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করেন অর্জুন। একইসঙ্গে তিনি ক্ষুব্ধও।
সূত্রের খবর, অর্জুনবাবুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের মামলা রয়েছে। সেসবের মাধ্যমে রাজ্য তাঁর ওপর চাপ তৈরি করছিল। সে সব থেকে বাঁচতেই তিনি বিজেপি থেকে এসেছিলেন তৃণমূলে। এবার ফের বিজেপি-তে এলে রাজ্যের চাপের মুখে তাঁকে পড়তে হতে পারে।
এর পরেও একটা প্রশ্ন— গতবার তৃণমূলে টিকিট না পেয়ে বিজেপি-র প্রার্থী হয়ে জিতেও দলবদল করেছিলেন। বিজেপি কি তাঁকে ফের প্রার্থী করবে? ইতিমধ্যেই প্রাক্তন রাজ্যপাল তথাগত রায় এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, “উত্তর ২৪-পরগনা জেলার শিল্পাঞ্চলের মাফিয়া দলের সদস্য, টিএমসি ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি কেডিএসএ (চার বিজেপি নেতা কৈলাশ-দিলীপ-শিব-অরবিন্দর নামের আদ্যক্ষর) গ্যাং এর সৌজন্যে একটি টিকিট পেয়েছিলেন, জিতেছিলেন এবং অবিলম্বে টিএমসিতে ফিরে যান। এবার টিএমসি তাঁকে টিকিট দিতে অস্বীকার করেছে। এখন তিনি বিজেপিতে তদ্বির করবেন। আমার অনুরোধ: দশ ফুট খুঁটি দিয়েও তাঁকে স্পর্শ করবেন না।” এই বার্তা তথাগতবাবু যুক্ত করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর অফিসের এক্স হ্যান্ডলের সঙ্গে।
বিজেপি সূত্রের খবর, পার্থ ভৌমিককে হারানোর পক্ষে অর্জুনবাবুই আদর্শ প্রার্থী। লোকসভা কেন্দ্রটি ৭টি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে গঠিত। এগুলি হল- আমডাঙা, বীজপুর, নৈহাটি, ভাটপাড়া, জগদ্দল, নোয়াপাড়া ও ব্যারাকপুর। প্রচুর হিন্দিভাষী ভোটদাতা আছেন এই সব অঞ্চলে। অর্জুনবাবুকে বিজেপি প্রার্থী করলে ভোটের সিংহভাগ পড়বে তাঁর ঝুলিতে।
এ ছাড়াও, একাধারে বাহুবলী এবং অর্থবানই কেবল নন, প্রার্থী হলে তিনি অর্জুনের লক্ষ্যভেদের মত তৃণমূল প্রার্থীকে হারানোর অঙ্গীকার করবেন। ‘গান্ধারীর আবেদন’-এ দুর্যোধন বলেছিলেন “…জয়, জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ।“ বারাকপুরে সেভাবে একমাত্র অর্জুনবাবুই শেষ হাসি হাসতে পারেন।
এ সব জেনেও আগাম ঘুঁটি সাজিয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী পার্থ। বছর ছয় আগেও এলাকায় নিছক নাট্যকর্মী হিসাবে মানুষ জানতেন তাঁকে। লোকসভা ভোটে জিতলে তাঁর উত্থানের গতি আরও দ্রুত হবে। তাই “বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী”— আসন্ন ভোটযুদ্ধ তাঁর কাছে কুরুক্ষেত্রর মতই গুরুত্বের।
পরবর্তী অধ্যায়গুলো দেখাতে পারে একমাত্র সময়ই।