Aparajita Bill, Mamata, ‘অপরাজিতা বিল’ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে খোলা চিঠিতে ১৩-দফা

আমাদের ভারত, ৭ সেপ্টেম্বর: “এক তরুণী চিকিৎসকের নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যায় যখন জনসমাজ ক্রোধ ও শোকে উত্তাল, সেই অস্থির সময়ে, মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে এই বিল পাশ করা হলো। যে কোনও আইন পাশ করার আগে তার খসড়া প্রকাশ করা, নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করার দীর্ঘ প্রথা চলে আসছে। রাজ্য সরকার তা করেনি, যা অগণতান্ত্রিক। এতে আমরা আশাহত।”

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এভাবে চিঠি দিলেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের সুপরিচিত মহিলারা। চিঠিতে লিখেছেন, ‘অপরাজিতা মহিলা ও শিশু (পশ্চিমবঙ্গ ফৌজদারি আইন সংশোধন) বিল, ২০২৪,’ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় পাশ হল ৩ সেপ্টেম্বর, মাত্র এক দিনের মধ্যে। এই বিল-এর নামে ‘অপরাজিতা’ শব্দটির প্রয়োগ অসঙ্গত। ধর্ষণ, অ্যাসিড আক্রমণ, হত্যা বা অন্যান্য জঘন্য অপরাধের প্রেক্ষিতে কোনও কাব্যিক শব্দের প্রয়োগ হিংসাকে লঘু করে দেখাতে পারে। আইনের নামকরণের একটি সর্বজনগ্রাহ্য প্রথা রয়েছে। তা থেকে রাজ্য সরকারের অকারণ এবং অসঙ্গত বিচ্যুতিতে আমরা অসন্তুষ্ট।

*নামকরণে এমন বিভ্রান্তির পরেও এই বিল-এ ধর্ষিত মেয়েদের জন্য ‘ভিক্টিম’ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে, ‘সারভাইভার’ শব্দটির উল্লেখ করা হয়নি, এমনকি যাঁরা ধর্ষণের পর ন্যায়ের জন্য লড়াই করছে, সেই মেয়েদের জন্যেও নয়। এতে আমরা হতাশ।

*এই আইনের নামকরণে ‘মহিলা ও শিশু’ একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে মেয়েদের স্বাধীন সত্ত্বা ব্যাহত হয়েছে, মাতৃত্বকে নারীত্বের প্রধান আধার বলে দেখানো হয়েছে। এতে আমরা বিচলিত। আমরা মনে করি, বিলে ‘উওম্যান’ শব্দটির পরিবর্তে ‘উইমেন’ ব্যবহার করা উচিত।

*এই বিল-এ রূপান্তরকামী ব্যক্তিদের সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (২০২৩) ট্রান্স ও কুইয়র মানুষদের উপর যৌন আক্রমণ বিষয়ে নীরব, এবং রূপান্তরকামী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা আইনে (ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস প্রোটেকশন অব রাইটস অ্যাক্ট, ২০১৯) এই ব্যক্তিদের উপর যৌন অপরাধের সাজা সর্বোচ্চ দু’বছরের কারাদণ্ড। এই সময়ে রাজ্যের সংশোধনে এ বিষয়টি আনলে রূপান্তরকামীদের উপর হিংসার যথাযথ প্রতিকারের সম্ভাবনা ছিল। এই সুযোগ গ্রহণ করা হল না, তা আমরা লক্ষ করেছি।

*এই বিল ধর্ষণ প্রতিরোধের উপায় রূপে প্রধানত গ্রহণ করেছে শাস্তির কঠোরতার বৃদ্ধিকে। প্রতিটি অপরাধের ন্যূনতম শাস্তি বাড়ানো হয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা কিন্তু বলে, শাস্তি যত কঠোর হয়, অপরাধী সব্যস্ত হওয়ার হার তত কমে। তাই আমরা উদ্বিগ্ন।

*এই বিল-এ ধর্ষণ ও হত্যার (অথবা আঘাতের ফলে চেতনা হারিয়ে জড় অবস্থায় চলে যাওয়ার) একমাত্র শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে প্রাণদণ্ড ও জরিমানা। এটা অসাংবিধানিক। সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ ১৯৮৩ সালের একটি রায়ে বলেছে যে, কোনও অপরাধের ক্ষেত্রেই ফাঁসি একমাত্র সাজা হতে পারে না। তাই আমরা বিস্মিত।

*ধর্ষণ ও যৌন নিগ্রহের বিচারের জন্য স্পেশাল কোর্ট তৈরির প্রস্তাবে আমরা আশ্বস্ত হতে পারছি না। আমরা দেখছি, পকসো-সহ বিভিন্ন ধরনের স্পেশাল কোর্টের অনেকগুলির পরিকাঠামো, অর্থবল এবং লোকবল সাধারণ আদালতের চাইতে কম। প্রায়ই আইনের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে বিচার শেষ হয় না।

*তেমনই, স্পেশাল টাস্ক ফোর্সও কার্যকর হবে না, যদি না যথেষ্ট সংখ্যায় দক্ষ কর্মী এবং যথেষ্ট বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়। সংহতির অভাব থাকবে কি না, সে চিন্তাও থাকছে। জেলাস্তরে এক একজন ডিএসপি এখনই অতিরিক্ত মামলায় ভারাক্রান্ত। কাজের ভার আরও বাড়ালে অভিযোগ নথিভুক্তি কমার সম্ভাবনা দেখা দেবে।

*এই বিল (ধারা ২৯সি, ৩ ও ৪) বলছে, স্পেশাল টাস্ক ফোর্স তদন্তে নেমে মৌখিক ভাবে বা লিখিত ভাবে যে ব্যক্তির কাছে সহায়তা চাইবে, তাকেই অবিলম্বে সাহায্য করতে হবে। না হলে তার জেল, জরিমানা হবে। কে সহায়তা দানে বা সাক্ষ্য দানে ‘অনিচ্ছুক’, তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা কোন স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের মতো একটি তদন্ত সংস্থাকে দেওয়া হবে? কেবল আদালতের ক্ষমতা রয়েছে সমন পাঠানোর, এবং তা অগ্রাহ্য করলে শাস্তি দেওয়ার।

*এই বিল-এ ধর্ষণের তদন্তের সময়সীমা ৬০ দিন থেকে ২১ দিন করা হয়েছে। আগের ৬০ দিনের সময়সীমা আইনের সুসংহত ধারণা থেকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। ইচ্ছেমতো সময় কমালে তদন্তের গুণমানে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, এই আমাদের উদ্বেগ।

*এই বিল-এ অপরাধীর জরিমানা করার কথা বলা হলেও, রাজ্য সরকারের তহবিল (ভিক্টিম কমপেনসেশন ফান্ড) থেকে ধর্ষণ-অতিক্রান্ত মেয়েদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনও উল্লেখ নেই। এতে আমরা বিস্মিত।

*এই বিল-এ বলা হয়েছে, “দেয়ার ইজ় নো ফাইনানসিয়াল ইমপ্লিকেশন ইনভলভড ইন গিভিং এফেক্ট টু দ্য প্রভিশনস অব দ্য বিল।” এর মানে কি এই যে, সরকার এই বিলকে কার্যে পরিণত করতে কোনও বাড়তি আর্থিক দায় গ্রহণ করছে না, বাড়তি বরাদ্দ দিচ্ছে না? কেবল কিছু আদালত এবং কিছু পুলিশ কর্মীর নামের তকমায় বদল আনলেই কী করে দ্রুত ন্যায় পাওয়া যাবে? বিশেষ বরাদ্দ না থাকলে ‘স্পেশাল কোর্ট’ বস্তুত সাধারণ আদালতের লেবেল বদল মাত্র।

*বিচার ব্যবস্থায় আরও অর্থ বরাদ্দ করা, আরও উন্নত পরিকাঠামো তৈরি করার ইচ্ছা ব্যতিরেকেই যদি রাজ্য সরকার এই আইন পাশ করে থাকে, তা হলে আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে এই বিল একটি অন্তঃসারশূন্য প্রতিশ্রুতি। আর জি কর ধর্ষণ ও হত্যা কাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় জনরোষের সামনে ‘অপরাজিতা বিল’ একটা তাৎক্ষণিক প্রতিশ্রুতি মাত্র। আইনটির নির্মাণ ত্রুটিযুক্ত, তা পাশ করানো হয়েছে তাড়াহুড়ো করে। যথেষ্ট চিন্তা, যথেষ্ট আলোচনা, যথেষ্ট রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কিছুরই ছাপ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। আমরা প্রশ্ন করতে বাধ্য হচ্ছি, এই আইন কি আদৌ আমাদের প্রয়োজন ছিল?

চিঠিতে সই করেছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রত্নাবলী রায়, পশ্চিমবঙ্গ আশা কর্মী ইউনিয়নের সচিব ইসমত আরা খাতুন, সমাজ উন্নয়ন কর্মী অঞ্চিতা ঘটক, শিক্ষক রুচিরা গোস্বামী, সাংবাদিক চন্দ্রিমা এস ভট্টাচার্য, নারীবাদী তিন আন্দোলন কর্মী কোয়েল ঘোষ, সোমা সেনগুপ্ত, অমৃতা দাশগুপ্ত, ট্রান্স নারীবাদী আন্দোলনকর্মী অনিন্দ্য হাজরা, দুই সমাজকর্মী মৌসুমী সরকার ও দিওতিমা চৌধুরী প্রমুখ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *