অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, ২৫ জুন: “হে পদ্মা! প্রলয়ংকরী! হে ভীষণা! ভৈরবী সুন্দরী!
হে প্রগলভা! হে প্রবলা! সমুদ্রের যোগ্য সহচরী
তুমি শুধু, নিবিড় আগ্রহ আর পার গো সহিতে
একা তুমি সাগরের প্রিয়তমা, অয়ি দুবিনীতে!”
পদ্মার প্রতি’-তে লিখেছিলেন ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। বাঙালির অস্থিমজ্জা, শয়ন-স্বপনের সঙ্গে মিশে আছে যে নদী, আজ শনিবার তার ওপর উদ্বোধন হচ্ছে বহু আলোচিত সেই সেতু।
সাহিত্যে বার বার এসেছে পদ্মা নদী— রবীন্দ্রনাথ থেকে তসলিমা নাসরিন। শৈশবে পদ্মার জলে ভাসতে ভাসতে কত ভাবনা খেলে বেড়াত রবীর মনে। পাঠক নানা সময় তার পরশ পেয়েছেন—
“হে পদ্মা আমার,
তোমায় আমায় দেখা শত শত বার।
একদিন জনহীন তোমার পুলিনে,
গোধূলির শুভলগ্নে হেমন্তের দিনে,
সাক্ষী করি পশ্চিমের সূর্য অস্তমান
তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরান।“
কতবার, কত রকম ভাবে কাব্য-সাহিত্যে পদ্মা এসেছে, তার ওপর সুন্দর আলেখ্য হতে পারে। আসলে পদ্মা মানে একটা আবেগ। আবার, রাজা রাজবল্লভের কীর্তি পদ্মার ভাঙ্গনের মুখে পড়ে ধ্বংস হয় বলে পদ্মার আরেক নাম কীর্তিনাশা। আবার মনে আসছে রবীন্দ্রনাথ—
“কতদিন ভাবিয়াছি বসি তব তীরে
পরজন্মে এ ধরায় যদি আসি ফিরে,
যদি কোনো দূরতর জন্মভূমি হতে
তরী বেয়ে ভেসে আসি তব খরস্রোতে—
কত গ্রাম কত মাঠ কত ঝাউঝাড়
কত বালুচর কত ভেঙে-পড়া পাড়।”
‘পদ্মার ঢেউ রে/ মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা, যা রে’, লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।
পদ্মার নৈসর্গিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নানাভাবে প্রভাবিত করেছে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। তার বিখ্যাত কিছু গানে পদ্মার হারানো ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য্য ফুটে উঠেছে। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাক রচিত “পদ্মার পলিদ্বীপ” উপন্যাসটির উপজীব্য পদ্মার পাড়ের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ এই নদীর তীরের মানুষের জীবনকে কেন্দ্র করেই লেখা। “পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার মরশুম চলিয়াছে। দিবারাত্রি কোনো সময়েই মাছ ধরিবার কামাই নাই। সন্ধ্যার সময় জাহাজঘাটে দাঁড়াইলে দেখা যায় নদীর বুকে শত শত আলো অনির্বাণ জোনাকির মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। জেলে–নৌকার আলো ওগুলি। সমস্ত রাত্রি আলোগুলি এমনিভাবে নদীবক্ষের রহস্যময় ম্লান অন্ধকারে দুর্বোধ্য সংকেতের মতো সঞ্চালিত হয়।”
১৯৩৪ সাল থেকে পূর্বাশা পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে এবং ১৯৩৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হওয়ার পরে ভারতীয় উপন্যাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাষায় অনূদিত হওয়ার গৌরব লাভ করে এই উপন্যাসটি। ভারতের একাধিক প্রাদেশিক ভাষাসহ ইংরেজি, চেক, হাঙ্গেরিয়ান, রুশ, লিথুয়ানিয়ান, নরওয়েজিয়ান ও সুইডিশ ভাষায় এই উপন্যাসের অনুবাদ প্রকশিত হয়। ১৯৯৩ সালে তৈরি হয় পরিচালক গৌতম ঘোষ নির্দেশিত ‘পদ্মা নদীর মাঝি’।
পদ্মা বাংলাদেশের প্রধান নদী। হিমালয়ে উৎপন্ন গঙ্গা নদীর প্রধান শাখা এবং বাংলাদেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর রাজশাহী এই পদ্মার উত্তর তীরে অবস্থিত। উইকিপিডিয়া এই তথা জানিয়ে লিখেছে, “পদ্মার সর্বোচ্চ গভীরতা ১,৫৭১ ফুট (৪৭৯ মিটার) এবং গড় গভীরতা ৯৬৮ফুট (২৯৫ মিটার)। বাংলাদেশে নদীটির দৈর্ঘ্য ১২০ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১০ কিলোমিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার।“ জানিনা, এই গভীরতা কবে মাপা হয়েছে।
আদৌ কতটা বিজ্ঞানসম্মতভাবে মাপা হয়েছে।
এখন নিশ্চয়ই অনেকটা কমে গিয়েছে গভীরতা!
হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন গঙ্গা নদী রাজশাহী জেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে, এখান থেকে নদীটি পদ্মা নাম ধারণ করেছে। গঙ্গার অন্য শাখাটি ভাগীরথী নামে ভারতে হুগলীর দিকে প্রবাহিত হয়। উৎপত্তিস্থল হতে ২২০০ কিলোমিটার দূরে গোয়ালন্দে যমুনা নদীর সঙ্গে মিলে মিলিত প্রবাহ পদ্মা নামে আরও পূর্ব দিকে চাঁদপুর জেলায় মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। সবশেষে পদ্মা-মেঘনার মিলিত প্রবাহ মেঘনা নাম ধারণ করে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হয়।
ভ্রাতৃপ্রতীম আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাক্তন সহকর্মী প্রেমাংশু চৌধুরী লিখেছেন, “শনিবার সকালে শেখ হাসিনা এই পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করবেন। পদ্মার ঢেউয়ের বাধা কাটিয়ে, বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত ছুঁচ্ছে সেই সেতু। মস্ত মাপের সব হোর্ডিংয়ে সেই সেতুর ছবির এক দিকে শেখ মুজিবের মুখ। অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মাঝে বার্তা, ‘তুমি স্বপ্ন দেখ, স্বপ্ন দেখাও বিশ্ব জয়ের’।
প্রেমাংশু লিখেছে, “নিছক নদীর উপরে তৈরি সেতু। সে তো ভূ-ভারতে কতই রয়েছে। পদ্মা নদীর উপরে তৈরি সেতু সে হিসেবে ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু একটা সেতু যে একটা গোটা দেশের মানুষের আবেগকে এ ভাবে তুঙ্গে নিয়ে যেতে পারে, তা ঢাকায় না এলে বোঝা যায় না।শনিবার সকালে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষায় শুক্রবার যেন বিনিদ্র রজনী কাটাতে চলেছে বাংলাদেশ।“
লেখার রাশ টানছি আবার সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের আবেগপূর্ণ কলমকে স্মরণ করে—
“না জানে সুপ্তির স্বাদ, জড়তার বারতা না জানে,
ভাঙ্গনের মুখে বসি গাহে গান প্লাবনের তানে,
নাহিক বস্তুর মায়া, মরিতে প্রস্তুত চির দিনই!
অয়ি স্বাতন্ত্রের ধারা! অয়ি পদ্মা! অয়ি বিপ্লাবনী!“