অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, ২৭ আগস্ট: এটি একটি কঠিন কাজ এবং কিছু সময় লাগবে। তাই আমাদের সবাইকে প্রতিবাদ এবং আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সময় খুব ধৈর্যশীল, সতর্ক এবং সাবধান থাকতে হবে।” এই ভাষাতেই ‘পশ্চিমবঙ্গের জনগণ’-এর কাছে লিখিত আবেদন করলেন প্রাক্তন আই এ এস আধিকারিক অতনু পুরকায়স্থ। প্রসঙ্গত, এই পদস্থ আমলার কন্যার মৃত্যুর প্রসঙ্গের সঙ্গে একটা বড় মিল রয়েছে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে এক যুবতী প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকের নৃশংস, বর্বর হত্যাকাণ্ডর। আমলা-কন্যার বিষয়টি জাতীয় স্তরে মাত্রা পেয়েছিলো।
আর জি কর-এর তদন্ত প্রসঙ্গে অতনুবাবু জানিয়েছেন, যতই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি হোক না কেন, কখনো আপনার অর্জিত সমস্ত জনসমর্থন এবং সহানুভূতি কেড়ে নিতে পারে এমনভাবে আইন ভঙ্গ করবেন না বা নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন না।”
৯ই আগস্ট কলকাতার নির্যাতিতার ঘটনা সমগ্র দেশের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। অতনুবাবু জানিয়েছেন, “এই ঘটনা দেশের সর্বত্র আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের লজ্জিত করেছে। আমি ভারতীয় প্রশাসনিক সেবা (আইএএস) -র সদস্য রূপে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের সেবায় আমার কর্মজীবনের দুই দশকেরও বেশি সময় অতিবাহিত করেছি এবং পশ্চিমবঙ্গের পতনেরও সাক্ষী থেকেছি। কিন্তু সেই পতন, এই ভয়ানক ঘটনার পর থেকে যতোটা তীব্র হয়েছে, তা আগে কখনোই এতটা তীব্র হয়নি!
এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে এবং ন্যায়বিচার দাবি করতে জনগণের সমর্থনে পুরো চিকিৎসক সমাজ প্রকাশ্যে রাস্তায় নেমে এসেছেন জনগণের সমর্থন নিয়ে। গোটা দেশ তাদের এই প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন। এমন কোনো রাজ্য বা মেডিকেল কলেজ নেই, যেখানে প্রতিবাদ মিছিল এবং চিকিৎসা পরিষেবা বয়কট করা হয়নি। সারা দেশের সংবাদমাধ্যম এই ঘটনাটি প্রচার করেছে এবং নিহত কন্যাটির জন্য ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছেন।
এই ঘটনার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত মর্মাহত এবং দুঃখিত তো বটেই, এবং সেই সঙ্গে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধও। কারণ ঠিক ১২ বছর আগে এই একই দিন এবং মাসে, ২০১২ সালে, আমার মেয়ে পল্লবী পুরকায়স্থ, যার বয়স তখন কুড়ির কোঠায় ছিল এবং যে পেশায় একজন তরুণ অ্যাডভোকেট, মুম্বাইয়ের তার ফ্ল্যাটে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় তার বিল্ডিংয়েরই নাইট গার্ড তাকে নির্মমভাবে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। তার অপরাধ ছিল যে, সে সাহসের সাথে সেই নাইট গার্ডের অসদুদ্দেশ্য প্রনোদিত আচরণ প্রতিহত করেছিল! আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো এই ঘটনাটি মনে করতে পারবেন।
সেই সময়েও এই ঘটনাটি প্রচুর জনসমর্থন, ক্রোধ এবং ভয়ের সৃষ্টি করেছিল। সমর্থন ও ক্রোধ, কারণ একজন তরুণীর জীবন নির্মমভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল এবং ভয়, কারণ এই অপরাধটি ঘটিয়েছিল সেই ব্যক্তি (বিল্ডিংয়ের নাইট গার্ড), যার দায়িত্ব ছিল তাকে সুরক্ষিত রাখা। যখন রক্ষকই ভক্ষক হয়ে যায়, তখন মানুষ জানে না কাকে বিশ্বাস করবে! তবে জনস্মৃতি স্বল্পমেয়াদী, এবং এই ধরনের ঘটনা বিস্মৃতির আড়ালে চলে যায়, কেবল দুঃখিত বাবা-মা তাদের প্রিয় সন্তানকে হারানোর শোক নীরবে বহন করে যায় আজীবন।
পল্লবীর ন্যায়বিচারের প্রসঙ্গে জানাই যে এ ক্ষেত্রে মুম্বাই সেশন কোর্ট অপরাধীকে কেবল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন, যদিও আইন এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ী, এই মামলা “অতি বিরল” গোত্রের মধ্যে পড়ে এবং অপরাধী মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কিছুই পাওয়ার যোগ্য ছিল না। মহারাষ্ট্র সরকারকে ধন্যবাদ, তাঁরা তৎপরতার সঙ্গে ২০১৪ সালে বোম্বে হাইকোর্টে অপরাধীর মৃত্যুদণ্ডের জন্য আপিল দায়ের করেছিলেন। তবে, দুর্ভাগ্যক্রমে, সেই থেকে মামলাটি হাইকোর্টে ঝুলে আছে। বহুবার তালিকাভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও, মাননীয় বিচারপতিরা গত দশ বছরে একবারও এই মামলাটি শোনার সময় পাননি!
একটি সরাসরি হত্যাকাণ্ডের মামলাতেও ন্যায়বিচারের পথ কতো দীর্ঘ এবং নিঃসঙ্গ হতে পারে সে সম্পর্কে আপনাদের সচেতন করার জন্যই আমি এখানে আমার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছি। সেই সঙ্গে এটাও দেখাতে চাইছি যে, আমাদের দেশের অপরাধ বিচার ব্যবস্থা কতটা অসংবেদনশীল, এমনকি এমন একটি মামলার বিষয়েও যেখানে নিহত হয়েছেন একজন নারী!
তার ওপর এই আর জি কর মেডিকেল কলেজের মহিলা ইন্টার্ন ডাক্তারের হত্যাকাণ্ড মোটেই একটি সরল মামলা নয়। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালের গুরুতর দুর্নীতি এবং মাফিয়ার সম্পৃক্ততার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে মেয়েটি তার জীবন হারিয়েছে। হাসপাতালের দুর্নীতি এমন একটি বিষয় যা আমাদের সকলকেই স্পর্শ করে। সীমান্তে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা একজন সাহসী সৈনিকের মতোই এই কন্যাটি মাফিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস দেখাতে গিয়েই তার জীবন দিয়েছে। আমাদের সবার জন্যই সে শহীদ! আমরা তাঁর আত্মত্যাগকে বৃথা যেতে দিতে পারি না! এখন আমাদের দায়িত্ব হলো এই লড়াইয়ের ন্যায়সঙ্গত পরিণতি নিশ্চিত করা।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আর জি কর মেডিকেল কলেজে দীর্ঘদিন ধরে অনেক নৃশংস অপরাধ ঘটছিল, যা এই ঘটনার মাধ্যমে এখন প্রকাশিত হয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে যে, হাসপাতাল প্রাঙ্গণে মাদক চোরাচালান, মৃতদেহ ও বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য পাচার, যৌনচক্র, পরীক্ষায় পাস করানোর জন্য ছাত্রছাত্রীদের থেকে অর্থ আদায় ইত্যাদি সবকিছুই হাসপাতাল প্রশাসনের যোগসাজশে ঘটছিল।
ইন্টার্ন মহিলা ডাক্তারটি অবশ্যই হাসপাতালের এই অবৈধ কার্যকলাপগুলোর প্রমাণ সংগ্রহ করেছিল, যা মাফিয়ারা জেনে যায় এবং তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। যেভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানা গেছে, তা একটি পরিকল্পিত হত্যার দিকে নির্দেশ করে। এটা সম্ভবত অন্য যারা এই কার্যকলাপগুলোর ব্যাপারে অবগত আছেন, তাদের একটি বড় বার্তা পাঠানোর উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।
কলকাতা পুলিশ আধুনিক যোগাযোগ সরঞ্জাম এবং পরিবহনব্যবস্থায় সজ্জিত, যাঁরা দ্রুততার সঙ্গে পর্যাপ্ত বাহিনী পাঠিয়ে শহরের যে কোনো হাসপাতালে তাণ্ডব প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু তাঁরা সেটা করেন নি। কলকাতার মতো শহরের কেন্দ্রে একটি শীর্ষস্থানীয় সরকারি হাসপাতালে ৬০০০-৭০০০ জনের একটি বিশাল জনতা তাণ্ডব চালিয়ে পালিয়ে যেতে পারে, এটি কেবল শহরে মাফিয়াদের পৃষ্ঠপোষকতার মাত্রাই নির্দেশ করে। আমার দীর্ঘ কর্মজীবনে, আমি কখনোই এরকম কোনো ঘটনার কথা শুনিনি, যা দেশের কোথাও ঘটেছে এবং পুলিশ সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে!
সিবিআই এই মামলাটি তদন্ত করছে এবং হাসপাতালের প্রাক্তন সুপারিনটেন্ডেন্ট সন্দীপ ঘোষ, একজন প্রধান সন্দেহভাজন, জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হচ্ছেন। অভিযোগ করা হয়েছে যে, হাসপাতালের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া অপরাধগুলো এমন প্রকৃতির যে, এগুলো অন্যদের সহযোগিতা ছাড়া ঘটানো সম্ভব নয়। আর যখন কোনো দল কোনো অপরাধ করে, সেখানে একজন নেতা থাকতেই হবে। যতক্ষণ না এই ভয়ঙ্কর অপরাধচক্রের নেতা শনাক্ত হয়, ততক্ষণ এই মামলাটি অমীমাংসিত থেকে যাবে এবং নিহত কন্যাটির প্রতি ন্যায়বিচার অসম্পূর্ণ থাকবে। আমি শুধু আশা করব, সিবিআই নিঃসন্দেহে এই কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ মামলাটি তদন্ত করতে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে ।
জনতার একটি অংশ, যাঁরা সম্ভবত ‘আত্মরক্ষার্থে’ উদগ্রীব, তাঁরা ‘সাত দিনের মধ্যে ফাঁসি দাও’ আওয়াজ তুলে হত্যাকারীর শাস্তির দাবি জানাচ্ছেন বটে, কিন্তু যেসব কারণে ইন্টার্ন মহিলা ডাক্তারকে হত্যা করা হয়েছে, হাসপাতালের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া সেই সব অবৈধ কার্যকলাপগুলোর কোনো উল্লেখ করছেন না।
সুতরাং ন্যায়বিচার দাবি করা মানে কেবলমাত্র ওই হত্যাকারী সঞ্জয় রায়ের শাস্তির দাবি করা নয়, যে শুধু হিমশৈলের চূড়ামাত্র। ন্যায়বিচার তখনই পূর্ণ হবে, যখন এই ভয়ঙ্কর অপরাধের সমস্ত অপরাধী, তাদের নেতা সহ, শাস্তি পাবে। তখন, এবং কেবল তখনই, এই তরুণ ইন্টার্ন মহিলা ডাক্তারের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না এবং তার আত্মা শান্তি পাবে।
আমি চাই, আপনারা সকলেই ন্যায়বিচারের এই যুদ্ধে সফল হোন; এবং প্রার্থনা করি, এই প্রিয় সাহসী কন্যার জন্য ন্যায়বিচারের পথ দীর্ঘ না হয়! আমি এবং আমার পরিবার সবসময় আপনাদের সঙ্গে আছি।”