সোমনাথ বরাট, আমাদের ভারত, বাঁকুড়া, ৪ অক্টোবর: জমিদারি প্রথা বিলোপ হয়েছে বেশ কয়েক দশক আগেই, জমিদারি না থাকলেও এলাকাবাসীর কাছে জমিদার বাড়ির পুজোর একটা আলাদা আকর্ষণ আজও রয়ে গেছে। বাঁকুড়া জেলাজুড়ে এরকম বহু জমিদার বাড়ির দুর্গা পুজো রয়েছে। এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানান পুরনো কাহিনী।
বাঁকুড়া জেলার পাত্রসায়ের নারায়ণপুরের জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো ঘিরেও রয়েছে জলদস্যুদের কবল থেকে জমিদারকে রক্ষা করার রোহমর্ষক কাহিনী। সাড়ে ৩০০ বছরের প্রাচীন এই জমিদারবাড়ি ঘিরে রয়েছে মুচিরাম ঘোষ থেকে মণ্ডল জমিদার হওয়ার এবং দামু – কামুর জলদস্যুদের সঙ্গে যুদ্ধের কাহিনি।
আজ থেকে প্রায় ৩৫০ বছর আগে বর্ধমানের নীলপুর গ্রাম থেকে জীবিকার খোঁজে মুচিরাম ঘোষ ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পাত্রসায়েরের নারায়ণপুর বোদাই নদীর তীরে এসে সেখানেই বসবাস শুরু করেন। সেখানে পরিচয় হয় বিশিষ্ট গণিতাচার্য শুভঙ্কর রায়ের সঙ্গে। তখন মল্ল রাজা ছিলেন গোপাল সিংহ। মুচিরাম ঘোষের অনুরোধে এক দিন শুভঙ্কর রায় তাকে বিষ্ণুপুরে মল্ল রাজার কাছে নিয়ে যান। শুভঙ্করের অনুরোধ ও মুচিরাম ঘোষের ব্যবহার এবং কার্যকলাপে খুশি হয়ে মল্ল রাজা দামোদরের উপনদী বোদাই- এর তীরে বিশাল এলাকার জমিদারির দায়িত্ব দেন মুচিরামকে। নারায়াণপুর- এর পাশের গ্রাম হদল- এর মাঝে বিশাল জমিদার বাড়ি তৈরি হয়। তখন থেকেই এলাকাটি হদলনারায়ণপুর হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। জমিদার হিসেবে ব্রিটিশদের সঙ্গে সু- সম্পর্ক গড়ে তোলে মুচিরাম।
এদিকে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ওই এলাকার সাতটি নীলকুঠী ইজারা নিয়েছিল সেখানকার মণ্ডলরা। তারা বোদাই নদীতে বজরায় নীল বোঝাই করে দূর দুরান্তে রফতানি করতো। একদিন নীল বিক্রি করে প্রচুর ধন সম্পদ নিয়ে বজরায় করে গ্রামে ফিরছিলেন তারা। ফেরার পথে জলদস্যুদের কবলে পড়েন তাদের কোনও এক পূর্বপুরুষ। সেই সময় জমিদার মুচিরাম ঘোষ ও তার দুই লাঠিয়াল দামু ও কামু ওই বজরায় ছিলেন। হঠাৎ করেই জমিদারের বজরায় হানা দেয় জলদস্যুরা। তখন নিজেদের জীবন বাজি রেখে জলদস্যুদের সঙ্গে লড়াই করে দামু ও কামু। জলদস্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরে বজরায় থাকা সমস্ত সম্পত্তি দেবী দুর্গার নামে দেবত্র করে দেওয়ার মানত করেন তিনি।
এসময় ঘোষ থেকে মন্ডল হয়ে যান তিনি বলে কথিত আছে। ওই বজরায় থাকা সমস্ত ধনসম্পদ দিয়ে বিশাল দুর্গা দালান, রাস মঞ্চ, রথ মন্দির, নাটমন্দির, নহবতখানা তৈরি করেন মুচিরাম। জলদস্যুদের সঙ্গে লড়াইয়ের প্রতীক হিসাবে জমিদারবাড়ির দালানে জ্বলানো হয় এক বিশাল ঝাড়বাতি। এক দিকে নীলকুঠির বিপুল আয়, অন্যদিকে বিশাল জমিদারির খাজনায় ফুলে ফেঁপে ওঠে রাজকোষ। দুর্গামন্দির-সহ সমস্ত মন্দির সাজানো হয় বেলজিয়াম কাঁচের বিশাল বিশাল ঝাড়বাতিতে। সেই সময় দুর্গাপুজোয় পুতুল নাচের আসর ও যাত্রার আসর বসত। দেবীর পুজোর নির্ঘণ্ট ঘোষিত হত তোপধ্বনিতে। সেই সময় দূর দূরান্তের মানুষ ও প্রজারা হাজির হতেন জমিদার বাড়িতে। বর্তমানে সেই নীল কুঠিও যেমন নেই, তেমনি জমিদারিও নেই। তবে দেবীর পুজোর জন্য বিশাল দেবত্র এস্টেট ও জমি আছে। জমিদার বাড়ির এই ঐতিহ্য বজায় রেখে আজও দুর্গা পুজোর আয়োজন হয় হদলনারায়ণপুরের জমিদার বাড়িতে।
পুজোর সময় পুরানো দিনের সেই ঝাড়বাতি এখনও বার করে তার ধুলো ঝেড়ে টাঙানো হয় দালানে। যা অতীত স্মৃতিকে উসকে দেয়।