(খড়দার ভূমিপুত্র কৃষিবিজ্ঞানী ড. কল্যাণ চক্রবর্তী খড়দায় একাদিক্রমে ৩৫ বছর অবস্থান করেছেন। তার সঙ্গে খড়দার মানুষের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক-সামাজিক যোগসূত্র আজও বিনষ্ট হয় নি। তিনি আপন-চারণায় সমকালীন সময়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন, তার মধ্যে সেই সময়ের স্থানীয় ইতিহাস কিছুটা ফুটে উঠবে এই আশায় তা পরিবেশিত হল। তিনি ব্যক্তিবিশেষকে আক্রমণ করার লক্ষ্যে এই ধারাবাহিক নিবন্ধ লিখছেন না, লিখছেন নিজেকে অবিরত জানতে, নিজের ফেলে আসা পথটির স্বরূপসন্ধান করতে, যাতে আগামীদিনে আরো নির্মল ভাবে সকলকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলতে পারেন। প্রস্তুত প্রতিবেদনটি তার ষষ্ঠ পর্ব)
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ২৪ ডিসেম্বর: ২০০০ সালের জানুয়ারি মাস, প্রথম দিক। হঠাৎ জাঁকজমক করে পুষ্প প্রদর্শনীর আয়োজন দেখল খড়দাবাসী। আয়োজকেরা ৯৯-এর নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে ভোট-মরশুমের মতো প্রচার শুরু করে দিয়েছিলেন। পরে বোঝা গেল, শাসকের বিরোধী শিবির যেহেতু বইমেলার দখল নিয়েছে, একটা পাল্টা-মেলা কিছু না করলেই নয়! খড়দার বই দখলে চলে গেল, ভাবা যায়! “কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে”! আমাদের মাথায় আগে এলো না!
এখন শীতকাল, কী করা যায়! এটা মরশুমী ফুলের সময়। চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, গাঁদা, গোলাপ আর নানান শীতের ফুল-সব্জি-সম্ভারে বাগান ভরিয়ে ফেলেছেন বাগানবিলাসীরা। খড়দাতেও টবে টবে তার অসাধারণ সৌন্দর্য, তাদের অধিকাংশই পার্টি দরদি অথবা শাসকের মিছিলের সমর্থক। তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া হয়ে গেলো পার্টির স্থানীয় নেতাদের। অর্থাৎ বকলমে বইমেলার বিপ্রতীপে শাসকদল একটি প্রতিস্পর্ধী-মেলা। বাইরে তার রঙ দেখানো চলবে না, দেখাতে হবে তার জৌলুস, তার কৌলিন্য এবং শাসকের শ্রেষ্ঠতা। বলামাত্রই কাজ! একটা নিরুত্তাপ অরাজনৈতিক ফুলমেলার আসরে জাঁকিয়ে বসলো রাজনীতির গনগনে রোদ্দুর।
ডিসেম্বর-জানুয়ারির শীতে সে কী উত্তাপ! রাজ্যে মেলা-খেলার রাজনীতির তখন থেকেই হয়তো দানা বাঁধার সলতে পাকানো শুরু। মুখে না বললেও কারো বুঝতে বাকি থাকলো না, কার কী রঙের তাস! ওপেন সিক্রেট বলে এটাকে। ব্যাকআপগুলি শীতের কুয়াশাতেও স্পষ্ট বোঝা যায় — কারা মাতব্বর, কাকে অতিথি করে আনা হচ্ছে, কারা কী উদ্দেশ্যে টাকা ঢালছেন, কোন রূপক-সংকেতিক ভাষায় কথা হচ্ছে — তার তন্বিষ্ট অনুধ্যান করে। সাধারণ হুজুগে বাঙালি অবশ্য ওসব নিয়ে ভাবতে নারাজ। একটা মেলা–খেলা বেলাশেষে পেলেই হল! তারা রোজকার জন্য বাঁচতে চায়, দৈনিক তারা মরে, মরবার এক নিত্যলীলা যেন! দূর-ভবিষ্যৎ দেখতেই ভুলে গেছে তারা। মেলা–খেলার মাদকাসক্তি আছে বলেই না দারিদ্র্য, বেকারী, অশান্তি, অপশাসন নিমেষে ভুলে থাকা যায়!
যাইহোক খড়দার বাইরে থেকে রাশিরাশি ফুল এলো, টব এলো গাড়িগাড়ি। চারিদিকে পুষ্পচর্চা হল প্রচুর, রাজনীতি নির্ভর সংস্কৃতি, আর সামনেই পুরভোট। রাজ্যে বড় আসনে বসেন যিনি, সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব-সমাসের ব্যক্তিত্ব ঠিকরে পড়ে, এলেন সেবার কৃষ্টির কলাপ বিস্তার করে, প্রধান অতিথি হয়ে। কিন্তু ভাষণে ফুল ছেড়ে বেরিয়ে এসে আলাদা কোনো কী বার্তা দিলেন তিনি! সম্পাদকীয় লিখেছিল স্থানীয় সংবাদপত্র ‘সংবাদ এখন’, ফুলমেলাতে এসে ফুলেই আটকে গেলেন তিনি। কেউ কেউ বললেন, ফুল ছুড়ে মেরেছেন তিনি।
ফুলের আমি, ফুলের তুমি, ফুল দিয়ে যায় চেনা! চেনা তো নিশ্চয়ই যায়! পদ্মচাষে, পদ্মপাতে নাকসিটকান অনেক বুদ্ধিজীবী! যেন কী একটা অপরাধ করে ফেলেছে ওই ফুল! কী জানি! বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীক চিহ্নে পদ্ম রাখা চলবে না, একটা সময় এমন আবদারকারীও এদেশে ছিল বটে! দোসর হতে পারেন এখনও তারা কেউ কেউ! খড়দায় রটে যায় বহুমূল্যের পুরস্কার পেয়েছেন অনেক রাঙাবাবু, ফুলবিলাসী। অনেকানেক সম্বর্ধনা, অনেক আয়োজন বুদ্ধিজীবীদের জন্য, অনেক খাঁটি-মার্কা ফুল-টিম-বিচারক।
ঢিলছোঁড়া দূরত্বে আমার বাসাবাড়ি। কৃষি আধিকারিকের পদ থেকে তখন এসেছি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসাবে এবং ফুলচাষ ও ল্যান্ডস্কেপ গার্ডেনিং যে বিশেষ শাখার অঙ্গ সে বিষয়েই আমার বিশেষজ্ঞতা। আমাকে ডাকা হয়নি কোনো দিনও, মেলাটা দেখার জন্যও নয়। অথচ রাজনীতি লুকিয়ে রাখার ব্যর্থচেষ্টার আয়োজক যারা, সবাই জানেন চৌদ্দ বছর আগে থেকেই হর্টিকালচার নিয়ে আমার পঠন-পাঠন ও চর্চা। যদি সংগঠনটি অরাজনৈতিকই হবে তবে এলাকার এক উদ্যানবিদ অধ্যাপককে কেনই বা ডাকা হবে না! নোট-বই কী নেই লোকাল-সিএমের কাছে! অনেকে টিটকিরি করতেন আমাকে, কী হল, আপনি কী ওদের ফুল নন! কেউ আদর করে ডাকতেন ‘আগাছা’। হ্যাঁ, মনে রাখতে হবে আগাছার সংজ্ঞা, “A plant in the wrong place……” শাপলার বিশুদ্ধ জলাতে পদ্মও ‘আগাছা’ পদবাচ্য। পোস্তর মাদক-জমিতে পপি ফুলও আগাছা। জল-জিরেতের মালিক যদি এইবেলা পদ্মচাষের উদ্যান বানাতে উদ্যত হন, তখন পদ্ম নয়, তিনি এক এক করে উপড়ে দেবেন শাপলার গেঁড়ো।
বিনা আমন্ত্রণে আমি সাধারণভাবে কোথাও যাই না। কারণ রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন অনাথ আশ্রমে যেতে বাধ্য হওয়া ‘ভেতরের আমি’ সবসময় বলে ওঠে, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস যখন আমার অভিভাবক, তখন সংসাররূপ মিশ্রণ-সংস্কৃতিতে জল বাদ দিয়ে সার-ভাগটিই নিতে হবে আমাকে, বিনা আমন্ত্রণে কাঙালের মতো চীনা-পোষাকের হাতছানি নয়। বইমেলার বন্ধুরা সদস্যতার নিদর্শ পূরণ করে টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন, ফুলমেলার কমরেডরা আসেননি, তাদের সে ভরসাও হয়তো ছিল না, ফুলের মধ্যে কোনটা পদ্ম আর কোনটা বসরাই লাল গোলাপ, ওরা জানেন। আমিও কী চাইনি — অলি আসুক, আসুক ভ্রমরের দল; বোলতা-ভীমরুলের চাক নয়! স্কুল বেলায় ‘Selfish Giant’ নামে একটি গদ্য পড়েছিলাম। স্বামী জয়ানন্দজী মহারাজ ক্লাস টেন ‘এ’ সেকশানে পড়াতেন। দৈত্যের বাগানে, কুসুমোদ্যানে “শিশুর মহামেলা”-র প্রবেশাধিকার নেই। খড়দহ কবে ঐশী-মালঞ্চ হবে বসে আছি, দিন গুণে, পথ চেয়ে। ফুলমেলায় দৈবীভাব ফুটে ওঠা এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা! জীবনবৃক্ষের যত যৌবন, একুশের কমলকলি। ফুল ফুটবে, ভ্রমরও আসবে, খড়দহবাসী আপন মনোভূমিতে ফুল ফোটাবেন। পদ্মের মতোই। কারণ হৃদয়ে শতদলই ফোটে। দলের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে হবে শতদল, তারপর সহস্রদল; কিন্তু একই থ্যালামাসে সযত্নে গাঁথা থাকবে, পুষ্পাধার হবে ভারতীয় সংস্কৃতির।
–ক্রমশঃ