মৎস্য উন্নয়নের টেঁকসই কথা

কল্যাণ গৌতম
আমাদের ভারত, ২ ফেব্রুয়ারি: কথায় বলে, “মাছের নামে নাকি গাছও হাঁ করে।” মেছোভেতো বাঙালির সঙ্গে গাছেরও যে সম্পর্ক আছে জানতাম না তখন। সেকেণ্ড ইয়ারে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপিকা। বললেন, ফিসমিল (Fishmeal) বলে একটা কথা আছে। ফসল চাষে মাছের বর্জ্য যেমন আঁশ, কাঁটা, রক্ত, নাড়িভুড়ি, পিত্তি ইত্যাদি পচিয়ে সার হিসাবে গাছে দিলে ফলন বাড়ে। এইভাবে গাছও মাছ খায়! শুনে খুব মজা পেয়েছিলাম। বাড়িতে এসে মা-কে বললাম সমস্তটা। মা শুনে বললেন, ও মা! টালিতে যে লাউ, চালকুমড়োর লতা তুলে দিই, তার গোড়ায় তো মাছের পিত্তি আর মাছ ধোয়া জল দিই মাঝেসাঝে; দেখোনি তুমি? তাতে কুমড়ো বা কুষ্মাণ্ড গোত্রীয় ফসলে ফ্রুট-ফ্লাই বা ফলের মাছির আক্রমণ কমে যায়। খনার বচনেও আছে, “লাউয়ের বল মাছের জল।/ধেনো মাটিতে ঝাল প্রবল।”

পরে জানলাম, মাছচাষ নিয়ে মায়ের অভিজ্ঞতা নেহাৎ কম নয়। দেশের বাড়িতে আমাদের পুকুর ছিল, জমি ছিল, বাড়ি ছিল। সবই একরাতে ফেলে এসেছিলেন কপর্দকশূণ্য হয়ে। এই নিয়ে বেশি চর্চা করা সমকালীন সময়ে রাজনৈতিক অপরাধ ছিল৷ তাই পশ্চিমবঙ্গের কোনো উদ্বাস্তু মা, তাঁর সন্তানকে ছোটোবেলায় শোনাতেন না সেসব ইতিহাস। পূর্বতন সুখ-বিরহিত দুঃখের চাইতে সন্তান তাঁর কাছে অনেক মূল্যবান। পাছে বালকের মুখ ফস্কে পূর্ব পাকিস্তানের সত্য ধরা পড়ে, পাছে নেকড়ের মতো পাহারাদেওয়া বামপন্থী ক্যাডাররা শনাক্তকরণ করতে না পারে, ‘এরা সাম্প্রদায়িক’! তখন নিজের লুঠের কথা শোনালেও সাম্প্রদায়িক পদবাচ্য হতে হতেন শরণার্থী মানুষ। বাংলার উদ্বাস্তু হিন্দু মায়েরা গোপনে কাঁদতেন। সে বয়সে আমি অনেকটা অনুভব করেছি এইসব কথা। ইতিহাসের ‘মাৎস্যন্যায়’ কেমন ছিল, ‘পুকুর চুরি’ বলতে কী বোঝায় — ছোটো বেলা থেকেই সামাজিক পরিস্থিতি বিচার করে বুঝতে শিখে গেলাম। পাতে মাছ জুটতো না, কিন্তু মাছ নিয়ে বঙ্গে উন্নয়নের ধারা কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা ছিল মায়ের। টেঁকসই মৎস্যচাষ নিয়ে পরীক্ষায় যা লিখতাম, তার অনেকটাই মায়ের কথা। ইদানীং কথা হল কৃষিবিদ প্রফেসর তরুণ কান্তি বোসের সঙ্গে। আমার এক নিকটাত্মীয় অ্যাকোয়াকালচার বিষয়ে খুবই দক্ষ, তাঁর সঙ্গে কথা বলে বিষয়ের গভীরে জানা গেল।

সকলের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝলাম, পুকুর ভিত্তিক চাষ-পদ্ধতির প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করতে হলে এবং গ্রামীণ দরিদ্র মানুষকে উচ্চ জীবন জীবিকার সন্ধান দিতে হলে মাছচাষে বেশ কিছু উপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। সেগুলি পরিবেশন করতেই প্রস্তুত নিবন্ধ।

১. রাজ্যে যে সকল জলদেহী পুকুর, খাঁড়ি, ভেরি, বিল, হ্রদ, ভেজাভূমি রয়েছে, সেগুলির উপযুক্ত সমীক্ষা দরকার। সরকারের তথ্যভাণ্ডারে কী রয়েছে এবং মানুষের নাগালে সেইসব তথ্য আছে কিনা। অনেক জলবাহী এলাকা মানুষের লোভ চুরি করে নিয়েছে, রাজনৈতিক অনেক দলের আস্কারাও থেকেছে। এখন জলাভূমির সর্বশেষ পরিস্থিতি কী, তা জেনে নিয়ে অন্তর্দেশীয় মৎস্যচাষের জন্য তা রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি। কোন জলাভূমিকে কী কাজে ব্যবহার করা যাবে, তা বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে সমীক্ষা ছাড়া সম্ভব নয়।

২. রাজ্যের যাবতীয় নদী-ভিত্তিক জালিকায় সম্বৎসর যাতে জলপ্রবাহ বজায় থাকে, তার জন্য বহু রাজ্যগামী নদীর ক্ষেত্র আন্তর্রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরে বোঝাপড়া দরকার।

৩. নদীগুলিতে সরাসরি দূষিত পদার্থ উন্মুক্ত করা পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড চূড়ান্ত কঠোর হোক। কঠোর হোক পুরসভাগুলি। কোনো অন্যায় মেনে নেওয়া চলবে না। দূষণ রোধ যথাযথ হচ্ছে কিনা, নিয়মিত পরিদর্শন দরকার।

৪. সামুদ্রিক নানান মাছের বিপুল ভাণ্ডার আছে মানেই ওভার ফিশিং বা যথেচ্ছ মাছধরা হবে, অতিরিক্ত শোষণ বা ওভার এক্সপ্লয়টেশন করা হবে, তা কখনোই যেন মনে না করা হয়। মাছ ধরার মধ্যে অনেক অযাচিত প্রজাতির মাছও উঠে আসে, তা বিনষ্ট করা যায় না।

৫. প্রজনন মরশুমে মাছধরা বন্ধ হওয়া দরকার। মাছের নানান প্রজাতির ক্ষয় ও বিলুপ্তির মূল কারণই হচ্ছে মৎস্য প্রজননে মনুষ্যকৃত প্রতিবন্ধকতা।

৬. মৎস্য ব্যবসায় যথাযথ সংরক্ষণ ব্যবস্থা যেমন হিমঘর, বরফ-বাক্স রাখা দরকার। দরকার মাছের উপযোগী চালান ব্যবস্থা বা ট্রান্সপোর্ট এবং বিপণনের ব্যবস্থা।

৭. যথাযোগ্য গুরুত্ব দিতে হবে মাছধরার পর তা প্রক্রিয়াকরণ করার কাজে এবং যুক্তমূল্য বৃদ্ধির জন্য।

৮. সামুদ্রিক মৎস্য শিকারে উপযুক্ত ভেসেল, জালের ব্যবহার এবং যোগাযোগের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে।

৯. মাছচাষীদের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি এবং কলাকৌশলের যাবতীয় প্রশিক্ষণ দেবার বন্দোবস্ত করা উচিত, উচিত তাদের সচেতন করা। এটা অন্তর্দেশীয় এবং সামুদ্রিক মৎস্যচাষ – দুই ক্ষেত্রেই করতে হবে।

১০. গড়ে তুলতে হবে মৎস্যজীবীদের জন্য কার্যকরী বহু সমবায়। তাদের জন্য থাকবে ন্যুনতম সুদে ঋণের ব্যবস্থা, তাদের বীমা বা ইনশিওরেন্সের সুযোগ।

পরিশেষে আর একটি প্রবাদ দিয়ে আমার কথাটি ফুরাবো। “লিখিব পড়িব মরিব দুঃখে/মৎস্য মারিব খাইব সুখে।” স্ব-রোজগার এবং কর্মসংস্থানমুখী লেখাপড়া না করলে যে দুর্গতি ও দুঃখ থেকেই যায়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মাছচাষ সম্পর্কে পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলার যুবকেরা কবে সুখ পাবে? নদীমাতৃক বাংলা পুকুর সম্পদেও সমৃদ্ধ। এই বাংলায় মৎস্য চাষ করে, মৎস্য মেরে, “মাছের তেলে মাছ ভেজে” কবে বাঙালি আত্মনির্ভর হবে? সুযোগ যথেষ্ট, বাজার আছে অফুরন্ত; কারণ “কাঙালি বাঙালি মরে মাছে আর ভাতে।” বাঙালির কখনও খেদ হবার নয় যে, “শাকে ভাতে ছিলাম ভালো, মাছ কিনে জ্বালা হল।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *