ঝিঙেফুল! বহু ফুলের জাত মেরেছে রান্নাঘর

কল্যাণ চক্রবর্তী

আমাদের ভারত, ২৪ মে:
রান্নঘর বহু ফুলের জাত মেরেছে। সজনে, সরষে, তিল, তিসি ফুলের অপরূপ সৌন্দর্য, তা কী রান্নাঘর মনে রেখেছে! চালতার বড় বড় পাতার মাঝে সুন্দর সাদা ফুল, যখন ফুটে ওঠে চোখ ফেরানো যায় না, কে মনে করে বলবে সে কথা! এই সুন্দরের ফসলগুলি আপামর মানুষের কাছে নন্দিত হয় না মোটেও। অথচ এদের দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

ঝিঙেফুল এমনই এক উজ্জ্বল হলুদের সম্ভার, সবুজ শাড়িটার বুকে সোনারঙের নকশা। অপরাহ্নে গড়ানো সূর্যের ডাকে ফুটে ওঠে সব্জির ক্ষেতে ক্ষেতে, জমির বেড়ার উপরে ফোটে অসংখ্য কুঁড়ি। প্রকৃতি বলে যায়, ওই বুঝি সন্ধ্যা নেমে এলো! হালের গরু নিয়ে চলো ফিরি গেহে।

রানী চন্দ “আমার মা’র বাপের বাড়ি” গ্রন্থে লিখছেন, “দিদিমার সময়ের হিসাব — ঝিঙাফুলে। বিকালবেলা বেড়ার ধারে ঝিঙাফুলগুলি ফুটে উঠলেই দিদিমা হাঁক দেন বউদের, চুলবাঁধার পাট সেরে নিতে। বলেন ‘ঝিঙাফুল ফুটে গেল, বেলা আর বেশি নাই গো, সুয্যিঠাকুর পাটে বসবেন — তুরন্ত কাজ সারো সকলে।’ এক ঝাঁক আলোর মতো উজ্জ্বল হলুদ রঙের ফুলগুলি ফোটার সঙ্গে সঙ্গে দিদিমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া যায় রোজ। এর আর অনিয়ম হয় না কখনো।”

কাজী নজরুল ইসলামের ‘ঝিঙেফুল’ নামে একটি কবিতা আছে।
“ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল।
সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-কুল – ঝিঙে ফুল।
গুল্মে পর্ণে লতিকার কর্ণে ঢলঢল স্বর্ণে ঝলমল দোলো দুল – ঝিঙে ফুল॥
পাতার দেশের পাখি বাঁধা হিয়া বোঁটাতে, গান তব শুনি সাঁঝে তব ফুটে ওঠাতে।
পউষের বেলাশেষ পরি জাফরানি বেশ মরা মাচানের দেশ করে তোলো মশগুল – ঝিঙে ফুল॥
শ্যামলী মায়ের কোলে সোনামুখ খুকু রে, আলুথালু ঘুমু যাও রোদে-গলা দুকুরে।
প্রজাপতি ডেকে যায় – ‘বোঁটা ছিঁড়ে চলে আয়!’
আশমানে তারা চায় – ‘চলে আয় এ অকূল!’ ঝিঙে ফুল॥ তুমি বলো – ‘আমি হায় ভালোবাসি মাটি-মায়, চাই না ও অলকায় – ভালো এই পথ-ভুল!’ ঝিঙে ফুল॥”

ঝিঙে কুষ্মাণ্ড গোত্রীয় একবর্ষজীবী একটি দীর্ঘ লতানো উদ্ভিদ; উদ্ভিদবিদ্যাগত নাম Luffa acutangula, ইংরেজি নাম Ridge Gourd বা Angled Luffa. ক্রান্তীয় দক্ষিণ এশিয়া এই ফসলের আদি বাসভূমি।

বাংলার সব্জির হাটে দারুণ কদর। যারা লোকশিল্পী, পটুয়া, তারা জৈবরঙের সঙ্গে ব্যবহার করেন কচি ঝিঙের আঠা। কচি ঝিঙেই বাজারে দর পায়, আর আঁশভারি বুড়ো-হাবড়া ঝিঙে শেষ হাটে গড়াগড়ি খায়। হাটুরেদের কেবল পরখ আর পরখ, আর এভাবেই অনবধানে জাত মেরেছে ঝিঙেফুলের। এই নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখবে কে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *