কল্যাণ গৌতম
আমাদের ভারত, ৩ জানুয়ারি: যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দ মহারাজ হিন্দু-জাতি-গঠন সংক্রান্ত নানা ভাষণ ও কাজে বারবার হিন্দু সম্রাট ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেন। ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হিন্দু সম্মেলনে হিন্দু রক্ষীদল গঠনের আহ্বান জানান তিনি এবং হিন্দু সমাজের বিপন্নতার বিষয় তুলে ধরেন। কারণ ১৯৩৭ সালের পর থেকে বাংলার রাজনীতিতে মুসলমান আধিপত্যবাদ বাঙ্গালি হিন্দুজীবনে গভীর সংকট তৈরি করেছিল। নোয়াখালিতেও তার বত্যয় ঘটলো না, গোলাম সারওয়ার ও গোফরানের নেতৃত্বে কৃষক সমিতির অন্তরালে একদল মানুষ হিন্দুদের মধ্যে ক্রমাগত আতঙ্ক সৃষ্টি করছিল; তারপর যা হয়েছিল, ইতিহাস তার সাক্ষী।
১৯৪০ সালের ৭ ই মে নোয়াখালিতে অনুষ্ঠিত হিন্দু সম্মেলনে হিন্দু রক্ষীদল কেমন হবে, তা বলতে গিয়ে স্বামীজি বললেন, “ছত্রপতি শিবাজী, শিখগুরু গোবিন্দ সিংহের জাতি গঠনের পদ্ধতি যেমন ছিল, আমার হিন্দু-জাতি-গঠন-আন্দোলনও সেই ধারায় পরিচালিত।” স্বামীজির আশীর্বাদধন্য ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, যাকে ‘শিবাজীর কার্যকরীরূপ’ বলে বর্ণনা করা হয়, তিনি নোয়াখালির হিন্দুদের দুর্দশার মোকাবিলাকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অগ্রাধিকার দিলেন। স্বামীজি এই যাত্রায় দক্ষযজ্ঞ ধ্বংসকারী শিবের রুদ্রমূর্তি সঙ্গে নিয়েছিলেন আর সঙ্গে নিয়েছিলেন বাছাই করা বীরদের।
“আমি কোনো কাপুরুষকে আমার সঙ্গে নেবো না, মাথা দিতে পারে, মাথা নিতে পারে — এমন লোক আমার সঙ্গে চলুক।” ত্রিশূল হস্তে আচার্যদেব মঞ্চে সর্বদা সমাসীন থাকতেন, পরিধানে পীতোজ্জ্বল কৌষেয় বসন, রুদ্রাক্ষের মালাধারী মূর্তিতে শিবাজীর পথে হিন্দুজাতি গঠন ও ধর্মরক্ষার বাণী। তাঁর সাফ কথা, “হিন্দু শির দিয়েছে, কিন্তু সার দেয় নাই।” আগের দিন ৬ ই মে পূর্ববঙ্গের বাবুরহাট সম্মেলনেও বললেন, “আজ প্রত্যেক হিন্দুকে রাণাপ্রতাপের মত, ছত্রপতি শিবাজীর মত, শিখগুরু গোবিন্দ সিংহের ন্যায় স্বধর্ম ও স্বসমাজের রক্ষার ব্রত ও দায়িত্ব গ্রহণপূর্বক জাতি-গঠন মন্ত্রে দীক্ষিত হতে হবে।” বাঙ্গালি হিন্দুর শিরায় শিরায় দুর্জয় বীর্যসঞ্চারের জন্য হৃদয়ে দুর্দম সঙ্কল্প প্রবাহের জন্য ১৩ ই মে কুমিল্লার হিন্দু সম্মেলনে স্বামীজি আবার শিবাজী-স্মরণ করলেন, “শিবাজী ও গুরুগোবিন্দ সিংহ যে পন্থায় যথাক্রমে মারাঠী ও শিখ জাতিকে মহাজীবন দান করেছিলেন, আমি বাঙ্গলায় সেই সংগঠন-পদ্ধতিক্রমে পরাক্রমশালী হিন্দু-সংহতি গঠনে বদ্ধপরিকর। এই আত্মরক্ষা ও আত্মগঠন প্রচেষ্টাকে যথেষ্ট প্রবল করে তুলতে পারলে হিন্দুসমাজের যাবতীয় তুচ্ছ ভেদ-বিবাদ ঘৃণা-বিদ্বেষ বিদূরিত হয়ে যাবে।”
এরপর দেখা যায় যুগাচার্য হিন্দুদের পাশে সতত অবস্থান করবার এক প্রবল পরাক্রমশালী হিন্দু নেতার সন্ধানে রত হলেন, যার মধ্যে শিবাজীর মতো অকুতোভয় শক্তি সঞ্চারিত আছে। অবশেষে ১৯৪০ সালের ২৬ শে আগষ্ট জন্মাষ্টমীর দিন আপন মাল্যে বরণ করে নিলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে, নিজের সামূহিক-শক্তি সঞ্চারিত করে দিলেন, বাঙ্গালির জন্য এক শিবাজী-প্রতিম নেতা নির্বাচন করে গেলেন। ওই বৎসরই শৈবপীঠ বারাণসীতে দুর্গাষ্টমীর দিন শ্যামাপ্রসাদকে রুদ্ধদ্বারে ডেকে নিয়ে জাগালেন তার মধ্যে থাকা যাবতীয় উদ্যম ও নৈপুণ্য।
প্রণবানন্দ-জীবনীকার স্বামী বেদানন্দ ‘শ্রীশ্রী যুগাচার্য জীবন চরিত’ গ্রন্থে খোলাখুলি লিখেছেন, “নিরপেক্ষভাবে বিচার করিলে শ্যামাপ্রসাদের প্রচেষ্টা ও সাফল্য মেবারের মহারাণা প্রতাপ অথবা মহারাষ্ট্রের ছত্রপতি শিবাজীর কীর্তির সহিত তুলনীয়।…. আচার্যের আশীর্বাদ শক্তিসমৃদ্ধ-শ্যামাপ্রসাদের অন্তরে সুপ্ত সিংহ গর্জন করিয়া উঠিল। বাংলার তথা সমগ্র ভারতের নেতাদের বিরুদ্ধে তিনি একক মহাবিক্রমে অভ্যুত্থান করিলেন। পাকিস্তান-রাক্ষসের কবলে সমগ্র বাংলাকে উৎসর্গ করিবার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া বাংলার এক-তৃতীয়াংশ পশ্চিমবঙ্গ ছিনাইয়া আনিয়া বাঙালি হিন্দুর দাঁড়াইবার স্থান ও অস্তিত্ব রক্ষার উপায় করিয়া দিলেন।…বাংলার বীর সন্তান শ্যামাপ্রসাদের জীবন-মাধ্যমে এইরূপে আচার্যের বাংলা ও বাঙালি জাতির রক্ষার সঙ্কল্প রূপায়িত হইয়াছিল।”