রহড়া-খড়দার সেদিনের দিনগুলি! বিজ্ঞান ক্লাবগুলি রাজনৈতিক দলের লেজুড় হিসাবে কাজ করত

খড়দার ভূমিপুত্র কৃষিবিজ্ঞানী ড. কল্যাণ চক্রবর্তী খড়দায় একাদিক্রমে ৩৫ বছর অবস্থান করেছেন। তার সঙ্গে খড়দার মানুষের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক-সামাজিক যোগসূত্র আজও বিনষ্ট হয়নি। তিনি আপন-চারণায় সমকালীন সময়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন, তার মধ্যে সেই সময়ের স্থানীয় ইতিহাস কিছুটা ফুটে উঠবে এই আশায় তা পরিবেশিত হল। তিনি ব্যক্তিবিশেষকে আক্রমণ করার লক্ষ্যে এই ধারাবাহিক নিবন্ধ লিখছেন না, লিখছেন নিজেকে অবিরত জানতে, নিজের ফেলে আসা পথটির স্বরূপসন্ধান করতে, যাতে আগামীদিনে আরো নির্মল ভাবে সকলকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলতে পারেন। প্রতিবেদনটি তাঁর দ্বিতীয় পর্ব

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

আমাদের ভারত, ২০ ডিসেম্বর: আটের দশকের শেষ দিক। তখন আমি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, হোস্টেলে থাকি। শনিবার-রবিবার বাড়ি আসি। নিজের কিছু কাজ সেরে সামাজিক কাজে অহরহ জড়িয়ে থাকতাম। যেমন ‘উত্তরণ’ নামে বিজ্ঞান সংস্থা। ১৯৮৭ সালে আমাকে ‘উত্তরণ’-এর সম্পাদকের দায়িত্ব দিলেন খড়দার ভালো ছাত্র বলে পরিচিত ছেলে-মেয়েরা। তাদের অনেকে বামপন্থী। তারা চাইতো বিজ্ঞান ক্লাবগুলি রাজনৈতিক দলের লেজুড় হোক, রাজনৈতিক ইস্যুগুলি বিজ্ঞান ক্লাবের মধ্যমে রূপায়ণ হোক। আমার মতামত তা ছিল না। বিজ্ঞান ক্লাবগুলি যথাসম্ভব আপন চেষ্টায় মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনায় কাজ করবে, এমন ছোটো ছোটো অথচ সুচিন্তিত কাজ যার প্রভাব বৃহত্তর। যেমন খাবারে ক্ষতিকর রঙের ব্যবহার বন্ধ করার আন্দোলন, খড়দার বাজারগুলিতে সব্জি ও ফল রঙের গামলায় চোবানো বন্ধ করানো, খড়দার সব বাড়ির সেফটি ট্যাঙ্কের নির্গমণ ছিদ্রে মশারির কাপড় লাগিয়ে দিয়ে মশার প্রজননক্ষেত্র বিনষ্ট করা, রক্তের গ্রুপ জানানোর জন্য শিবির রচনা, বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার কেরিয়ার কাউন্সেলিং, সস্তায় পুষ্টিকর খাবার তৈরি করা শেখানো, ফার্স্ট-এড/হোমনার্সিং/হাইজিন/স্যানিটেশন বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, গৃহে উদ্যান রচনার পরিকল্পনা, ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহার শিখিয়ে দেওয়া, দুঃস্থ ছাত্রদের নিখরচায় বিজ্ঞান পড়িয়ে দেওয়া।

অনেকেই এসব দায়িত্ব নিতে জানতেন না, তারা রাজনীতির অঙ্গ হিসাবে এসব করতেন, ফলে মানসিক দূরত্ব হতে লাগলো। তবে পরবর্তী সময়ে দেখেছি অন্যান্য সংগঠনের কেউ কেউ এ ধরনের কিছুটা কাজ শুরু করেছেন। ফলে ‘উত্তরণ’ সেই দিক থেকে খড়দার ছাত্র ও যুব সমাজের চেতনায় কিছুটা প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। এদিকে একটি বঙ্গ বিজ্ঞানমঞ্চ তৈরি হল, তারা কাদের দোসর সকলেই জানেন, ফলে উত্তরণের আয়ুও শেষ। আমি মঞ্চে ভিড়তে পারলাম না। রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রমের অনাথ ছাত্রদের শনিবার ও রবিবার বিনা বেতনে বিজ্ঞান পড়াতে গেলাম। তখন ছাত্রাবাসের অধ্যক্ষ অমরশঙ্কর মহারাজ (স্বামী বোধাতীতানন্দজী)। আমি স্নাতক স্তরের ছাত্র হওয়ায় তবুও তিনি পড়ানোর আমন্ত্রণ জানালেন। আমি কয়েকজন বন্ধুকেও পড়াতে নিয়ে গেলাম। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান মঞ্চের শাখা হল, আমাকে যোগদান করানোর জন্য টানাটানি শুরু হল, আমি যুক্ত হতে পারলাম না, তার খেসারত হয়তো অনেক দিতে হয়েছে পরে।

এদিকে খুব মনোবেদনা হল। বিজ্ঞানের কাজ ছাড়া বাঁচবো কীভাবে! বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আমাকে ‘সায়েন্স ফর সোসাইটি (ইন্ডিয়া)’-র আজীবন সদস্য করলেন। সেটাও আর একটি রাজনৈতিক দলের কথা কিছুটা মান্য করে চলতো সেই সময়। কিন্তু সেখানে এমন কিছু মুক্ত মনের মানুষ যুক্ত ছিলেন, যাদের সহায়তায় বিশুদ্ধ বিজ্ঞান চিন্তা রূপায়ণ করিয়ে নেওয়া কঠিন ছিল না। সেখানে বামপন্থী-ডানপন্থী উভয় চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন। সেই সংগঠনের হয়ে সারা বাংলায় বেশ কিছু কাজ করার সুযোগ পেলাম, সঙ্গে খড়দাতেও বহু বিজ্ঞানপ্রেমী মানুষকে একত্রিত করতে পারলাম। নানান জায়গার সঙ্গে কিছু কাজ শুরু হল খড়দাতেও – যেমন ভেষজ উদ্ভিদের নার্সারী ও চারা বিতরণ, ভেষজের ব্যবহার সম্পর্কে প্রচার, প্রয়োজনমতো নানা মানুষের কাছে ভেষজ উদ্ভিদ পৌঁছে দেওয়া, ভেষজ বিষয়ে পুস্তক রচনা ইত্যাদি। সংগঠনটি বিজ্ঞানমঞ্চের সঙ্গে সেই সময় পাল্লা দিতে পারেনি, কারণ সবাই মূল শাসকদলের সংগঠনে যুক্ত হতে চান, সেখানে প্রচার পাওয়ার সুযোগ বেশি। সায়েন্স ফর সোসাইটির পুরনো মানুষরা একের পর এক বয়সের কারণে চলে যেতে সংগঠনে নেতৃত্ব দেওয়ার মানুষের অভাব অনুভূত হল। আমিই ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ অথচ পুরনো কার্যকর্তা, কিন্তু আমার বিচারধারা ও মত সকলে জানতেন, আমাকে সংগঠনের মাথায় আনাটা হয়তো তারা সুবিধাজনক বিচার করলেন না, সহসম্পাদক হিসাবে অনেক দিন কাজ করলাম। পরে সংগঠনের আর অস্তিত্বও কার্যত রইলো না। যদি আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হত বিশুদ্ধ বিজ্ঞানচর্চা ও সম্প্রসারণের কাজটিই করতাম, প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানের উৎকর্ষ বিষয়গুলিকে আজও জীবনচর্যায় কাজে লাগানো যায় কিনা চেষ্টা করতাম, সে স্বাধীন সুযোগ হয়নি। তবে নানান সংগঠনে থেকে শুক্রাচার্য-পরিকরদের মাঝে ‘কচ’-এর মতো অনেক কিছুই শেখবার সুযোগ হয়েছে আমার, সংগঠন কীভাবে দাঁড় করাতে হয়, লোভী মানুষদের ছেড়ে সত্য সম্পর্কের কার্যকর্তা কীভাবে নির্মাণ করতে হয়, ইত্যাদি।

বিজ্ঞান আন্দোলন আমাকে সর্বদা যুক্তিবোধে চালিত করতে শিখিয়েছে, কারও কাছে অন্যায়ভাবে মাথা নত করতে শেখায়নি, যা ভেতর থেকে অনুভব করেছি, তা বিজ্ঞানবোধে বাঁধতে বাঁধতে চলেছি। এখনও আমি যখন সনাতনী সংস্কৃতির শুভঙ্করী ঐতিহ্যগুলিকে জ্ঞাপন করার প্রয়াস নিই, তার মধ্যে যুক্তি ও বিচারবোধকে প্রাধান্য দিই, শুধু আবেগের বশে কাউকে ডাক দিই না। আর প্রাচীন ভারতীয় দর্শন ও সংস্কৃতির প্রায় সবটাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত, আজও পাশ্চাত্যকে পথ দেখাতে পারে। –ক্রমশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *