অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, কলকাতা, ৯ নভেম্বর: “ইতিহাস হওয়া উচিত সত্য এবং বস্তুনিষ্ঠ। কিন্তু আমরা যে ইতিহাস পাই, তা সরকারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।” শুক্রবার ‘বিপ্লবী মহানায়ক সূর্য সেন স্মারক বক্তৃতায়’ এই মন্তব্য করলেন প্রবীন শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক সুদীন কুমার চট্টোপাধ্যায়।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম স্মৃতি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে দক্ষিণ কলকাতার শহিদ সূর্য সেন ভবনে এই সভায় সংস্থার সভানেত্রী লীলা পুরকায়স্থ বলেন, “যে পরিস্থিতিতে, যেভাবে মাস্টারদা তাঁর আন্দোলন পরিচালনা করেছন, তাকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। কিন্তু তাঁর আত্মত্যাগের শিক্ষা আমরা নিতে পারিনি। চারদিকে যে অব্যাবস্থা, সামাজিক চাপানউতোর চলছে, তাতে মাস্টারদা সম্পর্কে নতুন করে জানার, সেই ইতিহাস নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।”
সভায় বিশিষ্ট আইনজীবী তথা সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্যও ভাষণে ইতিহাসের মর্যাদার উপযোগিতার উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “আমরা এখন অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছি। যেখানে দাঁড়িয়ে চলমান ইতিহাসকে অন্তর দিয়ে রক্ষা করতে হবে। সমগ্র ভারতবাসীকে তা অনুভব করতে হবে। আমাদের ব্যর্থতা অভীষ্ঠ লক্ষ্যে আমরা পৌঁছোতে পারছি না।”
ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানী, ফকির বিদ্রোহ, পলাশির যুদ্ধ, নৌ বিদ্রোহ প্রভৃতি বিস্তীর্ণ পটভূমির উল্লেখ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন পরীক্ষা নিয়ামক, পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের প্রাক্তন সভাপতি সুদীনবাবু বলেন, অতীতের হানাদারদের লুন্ঠন, দাস বংশ, সৈয়দ বংশ, মোঘল বংশেরমত বহিরাগতদের আগমন, তাদের অভিযান, পীড়ন, এসবের পরে ঔপনিবেশিকতা—ওঁরা কেউ থেকে যাওয়ার জন্য এদেশে আসেননি। ফিরে গিয়েছেন মুঠো মুঠো সম্পদ নিয়ে। মন্বন্তরে কয়েক বছরের মধ্যে এক কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন মাস্টারদা। জালালবাদের পাহাড়ে, গ্রামেগঞ্জে-বন্দরে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন লড়াইকে।
“বিপ্লবের সেই আবহে শীর্ণকায়, শ্যামবর্ণ মাস্টারদা ব্রিটিশদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন। তাঁর ছবি, নাম, বিশদ পরিচয় ও পোষাকের উল্লেখ করে ১৯৩২-এর ২২ জুন পুলিশের তৎকালীন আইজি ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের ফেরারী আসামী’ সূর্য কুমার সেনকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন।” এ কথা জানিয়ে সুদীনবাবু সভায় বলেন, “হিন্দু-মুসলমানের ভেদাভেদ লুপ্ত করে দিয়েছিলেন মাস্টারদা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মাস্টারদাদের ভূমিকার ইতিহাস ধূসর থেকে ধূসরতর হয়ে আসছে।”
সুদীনবাবু বলেন, ১৯৭৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বিগত ৩০ বছরের নথি তাদের আইন অনুসারে প্রকাশ করেন। প্রতিটি প্রায় আড়াই হাজার পৃষ্ঠার, বেশ কয়েকটি খণ্ডে প্রকাশিত ওই সংকলনের শিরোনাম দেওয়া হলো ‘ট্রান্সফার অফ পাওয়ার’। সূর্য সেন বিপ্লবের নতুন দিগন্ত এনেছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্টের প্রাক্কালে জওহরলাল নেহরু মধ্যরাতে যে ভাষণ দেন, তার নির্যাস ছিল, এই স্বাধীনতা আনলেন বাপুজী। এভাবেই ইতিহাসের আখ্যানে লুকিয়ে কাঁদে সত্য। সূর্য সেন বিপ্লবের নতুন দিগন্ত এনেছিলেন। কিন্তু সব মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে।”
সভায় ধন্যবাদ জানান এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদক ও বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম স্মৃতি সংস্থার সহ সভাপতি ডঃ সত্যব্রত চক্রবর্তী। দেশাত্মবোধক সঙ্গীত পরিচালনা করেন স্মৃতি সংস্থার শিল্পীবৃন্দ। স্মৃতি সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক তপনবিকাশ দত্ত ও অজয়কুমার সেন বলেন, “১৯৭৫ সালে শুরু হয় ‘সূর্য সেন স্মারক বক্তৃতা’। প্রথমবার বক্তৃতা দিয়েছিলেন মাস্টারদার ফিল্ড মার্শাল, স্মৃতি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি, বিপ্লবী গণেশ ঘোষ।
মাঝে করোনাকালে ’২১ ও ’২২ ছাড়া প্রতি বছর এই বক্তৃতার আয়োজন করা হচ্ছে। মঞ্চে ছিলেন স্মৃতি সংস্থার সহ সভাপতি পরিমল ভট্টাচার্য।