রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’-রা! পরিবর্তনের পথে কাউকে না কাউকে বলিদান করতেই হয়

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

আমাদের ভারত, ৫ জানুয়ারি:
১. ‘ডাকঘর’ নাটকে রাজার চিঠি ডাকঘর থেকে আসবে। অমল অপেক্ষায় রয়েছে, কবে পাবে রাজার চিঠি! এই রাজা কে? এই রাজা মহাজীবন। জন্মলোক, মৃত্যুলোকের ঊর্ধ্বে যে জীবন। অমল মহাজীবনের উপাসক। জীবন আর মৃত্যু মানে দু’টি লোকে লোকান্তরিত হওয়া– “নাচে জন্ম, নাচে মৃত্যু/পাছে পাছে।” মহাজীবনের ডাক হল রাজার ডাক। এই নাটকে রাজার চিঠি মানে কী? চিঠি মানে বার্তা, রাজার বার্তা, রাজার খবর আসবে এমন বার্তা। মহাজীবনের বার্তা।

২. ‘রক্তকরবী’ নাটকে একটা জালের পিছনে রাজা থাকেন। নেপথ্যে তিনি। রহস্যময়তার আড়ালে তিনি। ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুৎসিত–কিছু জানা নেই তার। রক্তকরবীতে যে চরম উত্তরণ দেখানো হয়েছে, তা হল, রাজার এই জাল ছেড়ে বেরোনো এবং সেটা রঞ্জনের জীবনের মূল্যে, নন্দিনীর সৌকর্যে। ‘রঞ্জন’ মানে হল এখানে পরিবর্তন; রঞ্জন যেখানে যায় সেখানে ঢেউ-এর মতন পরিবর্তন আসে, সেখানে নীলকন্ঠ পাখি তার বার্তা দেয়। সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যায়; স্থবিরতাকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে। জীবনের কোনো কালিমা রাখে না সেখানে। যক্ষপুরীতেও ঢেউ নিয়ে উপস্থিত হয়। রক্তকরবীর নন্দিনী প্রাণ-চঞ্চলতার প্রতীক। নন্দিনী রঞ্জনকে নিয়ে আসে, ওটাই তার বার্তা। শেষে রাজা রঞ্জনকে হত্যা করে। প্রথম পরিবর্তনে সে বলিপ্রদত্ত হয়। পরিবর্তনের পথে কাউকে না কাউকে বলিদান করতেই হয়। সিপিএম শাসনের তৃণমূলের অনেক কর্মী-নেতা, তৃণমূল শাসনে বিজেপির বহু কর্মী-নেতার বলিদান ঘটেছে, পরিবর্তন এভাবেই আসে। শ্যামাপ্রসাদের মত অগ্র-পথিকের বলিদানে, দীনদয়াল উপাধ্যায়ের বলিদানে আজ বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায়। রাজার স্থবিরতা, রহস্যময়তা এভাবেই যুগে যুগে পরবর্তিত হয়। তার জন্যেই রঞ্জনের জন্ম।

৩. ‘রাজা’ নাটকে রাজা অরূপ, কেউ দেখেনি রাজাকে, রূপের কোনো বর্ণনা কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি নেপথ্যের নায়ক। তিনি ‘ভয়ানক’, দুর্দান্ত, full autocracy তার, supernatural তিনি। এই রাজা যেন বিরাট শিশু, এতটাই–সে যা চায়, তাই পায়। তিনিই সব। প্রায় সবটাই E, কতটা m রাখবেন, তিনিই ঠিক করেন। নাটকে দুই নারী, একজন রাজরাণী ‘সুদর্শনা’ আর একজন দাসী ‘সুরঙ্গমা’। রাণী সুদর্শনার রূপ আছে, সুন্দর দর্শন তিনি। বলেন, আমার রাজা, পুরোটাই আমার। রাধা ভাবে আচ্ছন্ন তিনি। রাজাকে চোখাচোখি দেখবেন। দাসী সুরঙ্গমা যেন জীবনের রঙ্গটা ধরতে পেরেছেন, উপলব্ধি করতে পেরেছেন; তার রূপের গর্ব নেই। আর গর্ব নিয়ে কখনও অরূপকে পাওয়া যায় না। তিনি যেন মীরার বোধ। সর্বদা রাজার পায়ের দিকে চোখ, মুখের দিকে তাকাতেই চান না। (লেখক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *