খড়দহে রবীন্দ্রনাথ

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

আমাদের ভারত, ১৯ জানুয়ারি: স্কুলবেলা থেকে শুনে এসেছি খড়দহ এবং পানিহাটি রবীন্দ্র-স্মৃতি বিজড়িত। এ বিষয়ে খড়দহবাসী এবং বহির্বাসী অনেক গবেষক তথ্যনিষ্ঠ অনুসন্ধান করেছেন। আমার বাবা রবীন্দ্রানুরাগী ছিলেন। তাঁর উপহারের চমক ছিল এক একটি বই। রবীন্দ্র-পরিকর সুধীরচন্দ্র কর-এর লেখা ‘কবি-কথা’ (প্রকাশকাল ১৯৫১) বইটি আমায় দিয়েছিলেন তিনি। ক্লাস সিক্সে যখন পড়ি রহড়ার জেলাগ্রন্থাগারে রবীন্দ্র-প্রশ্নোত্তর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের প্রস্তুতি হিসাবে কয়েকটি বই সাজেশনে রাখতে বলেছিলেন, তার অন্যতম এই বই।

প্রতিযোগিতায় সর্বসাধারণের মধ্যে আমি প্রথম স্থান অধিকার করলাম। এই বইয়ে খড়দহ সম্পর্কে রবীন্দ্র সংযোগের প্রথম সংবাদ পেলাম। সুধীরচন্দ্র খড়দহে বসবাসের সময় রবীন্দ্রসঙ্গী হয়ে এসেছিলেন। কী লেখা আছে বইটিতে জানাচ্ছি, “খড়দার গঙ্গার উপর এক বাড়ি, কবি সেখানে পুজোর সময়টা কাটাচ্ছিলেন। বউমা প্রতিমা দেবী ও নাতনি পুপে (নন্দিনী) কবির সঙ্গে ছিলেন; লেখককে কবির সঙ্গে সেবার কাটাতে হয়েছিল। এই সময়টিতেই ‘মালঞ্চ’ বইখানির অধিকাংশ লিখিত ও সংশোধিত হয়। শরৎ চট্টোপাধ্যায় মশায় এসেছিলেন সেবার কবি-সাক্ষাতে।” অনেক পরে ২০০৩ সালে প্রকাশিত বারাকপুর-নিবাসী কানাইপদ রায়ের লেখা ‘বারাকপুর মহকুমা এবং রবীন্দ্রনাথ’ (প্রকাশক: অংশুমান প্রকাশন, কলকাতা) বইটি আমার হাতে এলো। যদিও কানাইবাবুর সঙ্গে এ ব্যাপারে আগে কথা হয়েছে, যখন আমি ছাত্রাবস্থায় খড়দহের স্থানীয় সংবাদপত্র ‘সোনাইবার্তা’ সম্পাদনা করছি (নয়ের দশকের প্রথমদিকে)। সেই পত্রিকায় উনি খড়দহের সোনাই নদী নিয়ে লিখেছিলেন, বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তিনি গবেষণা শুরু করেছেন, পরে লিখবেন। শুনে আমরা অত্যন্ত আনন্দ পেলাম। পাণ্ডুলিপি লেখার জন্য আমাদের সাধ্যমতো একটি ঝর্ণা-কলম উপহার দিলাম। এই বইয়েরই একটি প্রবন্ধ ‘খড়দহে সৃষ্টির আনন্দে রবীন্দ্রনাথ’ (পৃষ্ঠা: ৪৭-৮৯), সেখানে কানাইবাবু খড়দহের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রকথন পরিবেশন করেছেন।

খড়দহবাসীর লেখা আরও একটি বই ‘খড়দহ-রহড়া — অতীত ও বর্তমান’ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। লেখক রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রয়াত শিক্ষক নিখিলরঞ্জন দে (প্রকাশকাল : ২০১৩)। এই বইয়েও খড়দহের রবীন্দ্র-স্মৃতি উপস্থাপন করেছেন নিখিলবাবু। ‘খড়দহে রচিত রবীন্দ্রসাহিত্য’ নামে একটি প্রবন্ধ সেখানে স্থান পেয়েছে (পৃষ্ঠা: ১০৬-১২৬)। খড়দহ-গবেষক তথা খড়দহ পুরসভার প্রাক্তন কর্মী তাপস মুখোপাধ্যায়ের গবেষণাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করার মতো। আমার সৌভাগ্য নানান সভা-সমিতিতে এই তিনজন গবেষকের বক্তব্য সরাসরি শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। সব মিলিয়ে কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য পরিবেশন করছি।

রবীন্দ্রনাথ খুব ছোটো বয়সে কলকাতায় প্রাদুর্ভূত ডেঙ্গু জ্বর থেকে রেহাই পেতে পানিহাটিতে এলেও, পরিণত বয়সে (বয়স তখন সত্তরোর্ধ) ক্লান্তিদূর করতে সাময়িক বসবাসের তাগিদে খড়দহে এলেন। খড়দহে প্রথম আসা ১৯৩২ সালের ১৬ ই জানুয়ারি। মোট চার পর্বে ৫৪ দিন তিনি খড়দহে অবস্থান করেছেন। এরই মাঝে এখান থেকেই তিনি গিয়েছিলেন পারস্য (১৯৩২ সালের ১১ ই এপ্রিল)। তাঁর খড়দহে অবস্থানের শেষ তারিখ ১৯৩২ সালের ১০ ই নভেম্বর। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে খড়দহে এসেছিলেন। খড়দহে অবস্থান কালে কবির সঙ্গী হয়েছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী এবং তাঁদের পালিতা কন্যা নন্দিনী। যে বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ অবস্থান করেছিলেন তার নাম ‘শিবালয়’, বাড়িটি শ্যামসুন্দর মন্দিরের অনতিদূরে, গঙ্গার তীরে। রবীন্দ্র-পরিকর ও কবি কান্তিচন্দ্র ঘোষ (১৮৮৬-১৯৪৮) কবিকে এই বাড়িতে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন পরিশ্রমে ক্লান্ত রবীন্দ্রনাথ, চাইছিলেন কোলাহল-মুক্তির সন্ধান; খড়দহ এনে দিল সে সুযোগ, “গঙ্গাতীরে আশ্রয় নিয়েছি। নির্জনে শান্তিতে আছি। বোধহয় শরীরও সুস্থ হয়ে উঠবে..”। খড়দহে বসবাসপর্বে রবীন্দ্রনাথ মোট ১৫ টি কবিতা লেখেন, ৪ টি অসম্পূর্ণ কবিতা সম্পূর্ণ করেন, ‘মালঞ্চ’ উপন্যাসের কিয়দংশ রচনা করেন, আর লেখেন ২৩ জনকে মোট ৩৬টি চিঠি। পত্র-প্রাপকেরা অধিকাংশই একটি করে চিঠি পেয়েছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ফরাসী সাহিত্যিক ও দার্শনিক রোমাঁ রোলাঁ, কবি বুদ্ধদেব বসু, সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, কবি অমিয় চক্রবর্তী, প্রশান্ত-পত্নী নির্মলকুমারী মহলানবিশ প্রমুখ। মৈত্রেয়ী দেবীসহ তিনজন দুটি করে চিঠি পান। তবে সবচেয়ে বেশি চিঠি পাবার সৌভাগ্য যার, তিনি হেমন্তবালাদেবী (১৮৯৪-১৯৭৬); মোট এগারোটি চিঠি তিনি পেয়েছেন। হেমন্তবালা বৈষ্ণবমতে দীক্ষিত এক সন্ন্যাসিনী, তিনি রবীন্দ্রনাথকে ‘দাদা’ সম্বোধন করে ডাকতেন।

খড়দহে বসে যে কবিতাগুলি রচিত হয় তা মূলত গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, সুরেন্দ্রনাথ কর প্রমুখ ছয়জন চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবির বিষয়বস্তু অবলম্বন করে। ১৯৩২ সাল নাগাদ খড়দহের চিত্র কেমন ছিল তা জানা যায় রবীন্দ্রনাথের লেখায় (পারস্যে)। খড়দহ থেকেই তিনি মোটরগাড়িতে চড়ে দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছন। তিনি লিখেছেন, “কলকাতার বাহিরের পল্লীগ্রাম থেকে যখন বেরলুম তখন ভোরবেলা। তারাখচিত নিস্তব্ধ অন্ধকারের নীচে দিয়ে গঙ্গার স্রোত ছলছল করছে। বাগানের প্রাচীরের গায়ে সুপুরিগাছের ডাল দুলছে বাতাসে, লতাপাতাঝোপঝাপের বিমিশ্র নিশ্বাসে একটা শ্যামলতার গন্ধ আকাশে ঘনীভূত। নিদ্রিত গ্রামের আঁকাবাঁকা সংকীর্ণ গলির মধ্য দিয়ে মোটর চলল। কোথাও-বা দাগ-ধরা পুরোনো পাকা দালান, তার খানিকটা বাসযোগ্য, খানিকটা ভেঙ্গে-পড়া; আধা-শহুরে দোকানে দ্বার বন্ধ; শিবমন্দির জনশূন্য; এবড়ো-খেবড়ো পোড়ো জমি; পানাপুকুর; ঝোপঝাড়। পাখিদের বাসায় তখনো সাড়া পড়েনি, জোয়ার-ভাঁটার সন্ধিকালীন গঙ্গার মতো পল্লীর জীবনযাত্রা ভোরবেলাকার শেষ ঘুমের মধ্যে থমকে আছে। গলির মোড়ে নিষুপ্ত বারান্দায় খাটিয়া-পাতা পুলিস-থানার পাশ দিয়ে মোটর পৌঁছল বড়ো রাস্তায়। অমনি নতুন কালের কড়া গন্ধ মেলে ধুলো জেগে উঠল, গাড়ির পেট্রোল-বাষ্পের সঙ্গে তার সগোত্র আত্মীয়তা। কেবল অন্ধকারের মধ্যে দুই সারি বনস্পতি পুঞ্জিত পল্লবস্তবকে প্রাচীনকালের নীরব সাক্ষ্য নিয়ে স্তম্ভিত; সেই যে কালে শতাব্দীপর্যায়ের মধ্যে দিয়ে বাংলার ছায়াস্নিগ্ধ অঙ্গনপার্শ্বে অতীত যুগের ইতিহাসধারা কখনো মন্দগম্ভীর গতিতে কখনো ঘূর্ণাবর্তসংকুল ফেনায়িত বেগে বয়ে চলেছিল। রাজপরম্পরার পদচিহ্নিত এই পথে কখনো পাঠান, কখনো মোগল, কখনো ভীষণ বর্গী, কখনো কোম্পানির সেপাই ধুলোর ভাষায় রাষ্ট্রপরিবর্তনের বার্তা ঘোষণা করে যাত্রা করেছে। তখন ছিল হাতি উট তাঞ্জাম ঘোড়সওয়ারদের অলংকৃত ঘোড়া; রাজপ্রতাপের সেইসব বিচিত্র বাহন ধুলোর ধূসর অন্তরালে মরীচিকার মতো মিলিয়ে গেছে। একমাত্র বাকি আছে সর্বজনের ভারবাহিনী করুণমন্থর গোরুর গাড়ি।” (লেখক ড. কল্যাণ চক্রবর্তী খড়দহের ভূমিপুত্র তথা কৃষিবিজ্ঞানী।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *