পরবের জেলা পুরুলিয়া মাতছে টুসুতে

সাথী দাস, পুরুলিয়া, ১৩ জানুয়ারি: পরবের জেলা পুরুলিয়া। পশ্চিমবঙ্গের অন্য কোথাও যে গ্রামীণ পরব ব্রাত্য পুরুলিয়ায় তাই সাদরে গৃহীত। টুসু, ভাদু, মকর, মনসা পূজা, ছাতা পরব, হোলি, শিবের গাজন, কাড়াখুটা, বাদনা, জাওয়া, করম ইত্যাদি পুরুলিয়ার প্রসিদ্ধ পরব। প্রতিটি পরবকে ঘিরেই কোথাও না কোথাও মেলা বসে। সে মেলার টানে সারা বছরই এ অঞ্চলের মানুষ উৎসুক হয়ে থাকে। পুরুলিয়া তাই মেলার দেশ। এই মেলার আকর্ষণে বহু মানুষ ছুটে আসেন পুরুলিয়ায়।

উল্লেখ্য, সারা পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জেলাতে আপন মাটি, প্রকৃতি ও মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুখ দুঃখ, বিরহ বেদনার রোজনামচা নিয়ে মানুষের মুখে মুখে সৃষ্টি হয় গান ও তার সঙ্গে নাচ এবং এলাকা ভিত্তিক সংস্কৃতি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এক জেলার লোকসংস্কৃতি ঋদ্ধ হয় অন্য জেলার লোকসংস্কৃতির প্রভাবে অর্থাৎ লোকায়ত জীবন হয়ে ওঠে মিশ্রসংস্কৃতি নির্ভর। অন্যদিকে পূর্বতন মানভূম বা বর্তমান পুরুলিয়ার বিশেষত্ব এখানকার মৌলিক সংস্কৃতি। তাই গবেষকরা এখানকার সংস্কৃতিকে ভার্জিন কালচার বলে থাকেন।

পৌষ সংক্রান্তির মকর বা টুসু এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় পরব। সারা বছরের আশা আকাঙ্খা মূর্ত হয় অগ্রহায়ণের ফসলে। অগ্রহায়ণ তাই বড় আনন্দের মাস। উৎসবের প্রস্তুতি এই মাসেই। এর পরেই আসে  পৌষ। পৌষ মাস উৎসবের মাস। অন্তত এই একটি মাস বোধহয় পেট পুরে খেতে পায় এক ফসলি খরার দেশের গ্রামের মানুষগুলো। মাস ফুরাতে না ফুরাতেই ধানের গোলা ফুরায়। এই মাসটিই মানভূম সিংভুমের টুসু পরবের মাস।


      
অগ্রহায়ণের  সংক্রান্তি থেকে পৌষ সংক্রান্তি এক মাস টুসু পুজো। তুষ থেকে টুসু। কেউ কেউ বলেন পৌষ লক্ষ্মী। কেউ বলেন, আদিম শস্যোৎসব। মূলত কুমারী মেয়েরাই এই ব্রত করে থাকে। বৈদিক যুগের প্রারম্ভেও নাকি এই ব্রতের প্রচলন ছিল। ধানের তুষ দিয়ে টুসু পাতা হয়। একটি নতুন সরা নিয়ে চালের গুঁড়ি গোলা জলে চোবানো হয়। পাঁচটি বা সাতটি সিঁদুরের লম্বা দাগ টেনে পরিষ্কার ঘরে পিঁড়ির ওপর রেখে টুসু বন্দনা চলে। নারী জীবনের গোপন অব্যক্ত কামনা বাসনা, দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সুখ দুঃখ, চলমান জীবনের সমসাময়িক ঘটনা প্রবাহ গানের মাধ্যমে তুলে আনা হয়। দেবত্বের ঘেরাটোপ ছেড়ে টুসু তখন সব মিলেমিশে পাশের বাড়ির মেয়ে হয়ে ওঠেন। টুসু পরবের প্রাণভোমরা মুখে মুখে রচিত এর ছড়া, এর সঙ্গীত। সংক্রান্তির দিনেই মকর পরব। এই দিনটির প্রতীক্ষায় থাকে সাবেক মানভূম। 

পুজো শেষে পৌষালি বিজয়ায় ছোট ছোট রঙিন কাগজের চৌডল টুসুর প্রতিভূ হিসেবে নদীতে ভাসানো হয়। ভাসানের টুসু গানে এ অঞ্চলের সমাজ ভাবনাও ফুটে ওঠে। জেলার গা ছুঁয়ে যাওয়া সুবর্ণরেখাই হোক বা বুক চিরে বয়ে চলা কংসাবতী, দ্বারকেশ্বর কিংবা কুমারী হোক, অথবা শিলাবতীর উৎপত্তিস্থল শিলাই।  পুরুলিয়ার সব নদীতীরেই রং লাগে পৌষ সংক্রান্তির দিনে।  মকর সংক্রান্তির পরের দিন পয়লা মাঘ। ‘আইখন যাত্রা’র দিন এ অঞ্চলে। রাঢ় অঞ্চলের নতুন বছরের প্রথম দিন। ঘরে ঘরে মাংস, পিঠে আর মহুল বা হাঁড়িয়া। সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে এ দিন অলস মেজাজে ছুটি কাটায় পুরুলিয়া জেলা। আর এক দিকে, ভোর থেকেই টুসু গানের কথায়-সুরে আন্দোলিত হয় বিভিন্ন নদী অভিমুখী মেঠো পথঘাট।  কনকনে ঠান্ডা উপেক্ষা করে এ দিন সুবর্ণরেখার তীরে ঝালদার তুলিন, বাঘমুণ্ডির সুইসা, কাঁসাই-পাড়ের দেউলঘাটা কিংবা পুরুলিয়া শহরের উপকন্ঠে শিমুলিয়া ঘাট, মহাদেববেড়া, পুঞ্চার কোণাপাড়া, মানবাজারের বুধপুর, দ্বারকেশ্বরের তীরে কাশীপুরের কাপিষ্টা, কুমারীর তীরে মানবাজার-২ ব্লকের দুয়ারসিনি, খড়িদুয়ারা কিংবা টটকোর পাড়ে বান্দোয়ানের যমুনা সব নদীতীরই থাকে এ দিন টুসুর চৌডলের রঙে রঙিন।

প্রান্তভূমির পদাবলি এই টুসু গান। পল্লীগ্রামের মাটির গন্ধে এই গান পুরুলিয়ার প্রকৃতির কোলের ঝর্ণার মতো সাবলীল ও সহজ। স্বচ্ছতা এর সুরে ও মাদকতায়। এই ভাষায় থাকে পাহাড়ের সৌন্দর্য, বনের সুগন্ধ। এ গান সম্পূর্ণভাবে প্রান্তভূমির মাটির গান, মাটির কাছাকাছি থাকা অনাড়ম্বর মানুষদের হৃদয় নিংড়ানো ব্যথা –বেদনার যথার্থ প্রতিচ্ছবি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *