আমাদের ভারত, ১ মে: “আজকের দিলীপ ঘোষ সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ। এই নতুন দিলীপ দার মধ্যে একটা অহংকার দেখা যাচ্ছে, যেটা আগে ছিল না। ‘আমি আমি’ করা একধরনের রাজনীতিক ব্যাধি, যা এখন তাঁর মধ্যে প্রকট।” বৃহস্পতিবার এই মন্তব্য করেছেন ভারতীয় জনতা যুব মোর্চার রাজ্য সহ সভাপতি তথা আইনজীবী তরুণজ্যোতি তিওয়ারি।
তরুণবাবু এক্সবার্তায় লিখেছেন, “গতকাল দিলীপ দা’র জগন্নাথ কালচারাল সেন্টারে যাওয়া নিয়ে আমার ব্যক্তিগতভাবে বিশেষ কোনো আপত্তি নেই। কারণ ওই কেন্দ্র সরকারের টাকায়, অর্থাৎ আমাদের করের টাকায় তৈরি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত অর্থে নয়।
যে কারণে সেখানে যাওয়াটা কোনও সমস্যা নয়। সমস্যা যা, তা হলো—হিন্দুদের উপর নির্যাতনের জন্য যিনি সরাসরি দায়ী, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে হাসিমুখে বৈঠক করা। সেটিকে সৌজন্য বলা হলে, সেই সৌজন্য আমাদের অপমান।
মালদা, মুর্শিদাবাদে হিন্দুদের উপর সংগঠিত বর্বর হামলার ঘটনায় যার সরকার দায়ী, যার নীরবতা হিংসাকে উৎসাহ দেয়, সেই মমতার সঙ্গে বৈঠককে রাজনৈতিক পরিপক্বতা বলে সাজানো যায় না। ‘এক মণ দুধে এক ফোঁটা চোনা’—এই বাংলার প্রবাদটাই বরং এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। জগন্নাথ সেন্টারে যাওয়া নয়, মমতার সাথে হাসিমুখে বৈঠকটাই দিলীপ ঘোষের রাজনৈতিক কেরিয়ারে সেই ‘এক ফোঁটা চোনা’ হয়ে রইল।
আজ সকালে দিলীপ দা’র একটি প্রেস বিবৃতি শুনলাম। সেখানে তিনি দাবি করলেন, তিনিই নাকি বহুজনকে নেতা বানিয়েছেন, এবং অনেকেই আজ তাঁর জন্য কামাচ্ছে। এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার করা জরুরি—নেতা বানানো যায় না, নেতা নির্বাচন করে মানুষ। দলের সংগঠন এবং আমাদের সাংগঠনিক কাঠামো কখনোই কাউকে নেতা বানায় না, বরং দায়িত্ব দেয়। দিলীপ ঘোষকেও দায়িত্ব দিয়েছিল দল, সংসদেও পাঠিয়েছিল দল। জননেতা কি না, সেটা ঠিক করে জনতা।
২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দিলীপ ঘোষ যেভাবে সংগঠনকে চাঙ্গা করেছিলেন, লড়েছিলেন, সেটা প্রশংসনীয়। সেই সময়কার দিলীপ ঘোষকে আমি সম্মান করি এবং করব।
অনেকে দেখছি কালকের ঘটনার পর ২০২১ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনী পরাজয়ের দায় দিলীপ ঘোষের ঘাড়ে চাপাচ্ছেন। এটা ঠিক নয়। প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষমতা তাঁর হাতে ছিল না। বরং বলা ভালো, যাঁরা ১৪৮ জন তৃণমূল কংগ্রেসের বিতর্কিত সদস্যকে দলে ঢুকিয়ে, প্রকৃত কর্মীদের বসিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের প্রশ্ন করুন।
ভাড়াটে সৈন্য দিয়ে যুদ্ধ জেতা যায় না। একুশে যাঁরা দলে এসেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই পরে আর থাকেননি। শুধু একজন এসেছিলেন—শুভেন্দু অধিকারী—যার প্রকৃত জনভিত্তি ছিল। বাকিরা ছিল ‘ছাঁট মাল’, যাঁদের দিলীপ ঘোষ কখনো গুরুত্ব দেননি।
একই কথা প্রযোজ্য ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও। কে কোথা থেকে দাঁড়াবে সেটা দিলীপ ঘোষ ঠিক করেননি। তাঁর নিজের জেতা আসনও কেন কাটা হলো, সেই উত্তর তো তিনিও জানেন না। সুতরাং পরাজয়ের দায় তিনিই নেবেন কেন?
তবে এটাও সত্যি যে, দিলীপ ঘোষ ভুল করেননি—এমন নয়। তাঁর অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বিতর্কিত। কিন্তু যে ভুলটা তিনি করেননি, সেটার দায় তাঁর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে সেটা অন্যায় হবে। যারা এটা করছেন, তারা আসলে আজকের ঘটনাকে কালিমালিপ্ত করতে চাইছেন।
একজন নেতার আসল পরিচয় পাওয়া যায় সঙ্কটকালে। এই সঙ্কটে দিলীপ ঘোষ যদি ভাবেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে হাসিমুখে বৈঠক করে তিনি বৃহত্তর রাজনীতির খেলায় নামলেন—তাহলে তিনি ভুল করছেন। কারণ সেই মমতার হাতে আমাদের শহিদের রক্ত লেগে আছে। সেই মমতার সাথে এক টেবিলে বসে ‘সৌজন্য’ রক্ষা করা মানে শহিদদের অপমান করা।
দিলীপ দা বলেছেন, তিনি নাকি অনেককে নেতা বানিয়েছেন এবং অনেকেই আজ তাঁর জন্য কামাচ্ছেন। মনে রাখা দরকার, রাজনীতিতে যারা এসেছেন, তারা সবাই গরিব ঘরের সন্তান না।
হঠাৎ অর্থলাভ থেকে জন্ম নেওয়া দম্ভ আর অভিজাত পরিবার থেকে আসা আত্মবিশ্বাস—এই দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে। অনেক গরিব ঘরের সন্তান আমাদের দলে আছে। তারাও নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী সবকিছু দিয়ে দলটা করে। দিলীপ দা তাঁর কথার মাধ্যমে সকলকে অপমান করলেন।
টাকার জন্য রাজনীতি করলে মানুষ তৃণমূল করত, বিজেপি নয়। বিজেপি যারা করে তারা আদর্শের জন্য করে। অর্থের অহংকার যখন কারও মধ্যে জন্ম নেয়, তখন মানুষ ভুলে যায়, সম্মান অর্জন করা যায়, কিনে নেওয়া যায় না।
আপনি আজ সকালে বলেছেন যে, অনেকে অর্থাৎ দলের অনেকে আপনার বিরুদ্ধে মন্তব্য করছেন এমন, যেন তারা আত্মহত্যা করবে। দিলীপ দা, চিন্তা করবেন না। লোকে আপনাকে ভালোবাসত, কিন্তু এতটাই ভালোবাসত না যে কেউ আপনার জন্য জীবন দেবে।
গতকালের বৈঠকে আপনি সেই ভালোবাসাটুকুও হারিয়েছেন। আপনি যেটা করেছেন, সেটা অন্য কেউ করলে হয়তো কষ্টটা কম হতো, কিন্তু আপনি করেছেন বলেই খারাপ বেশি লাগছে।
আমি নিজেও ভাবিনি কোনোদিন আপনাকে নিয়ে এইভাবে লিখব। কিন্তু আপনি বাধ্য করেছেন। ভালো কাজ করলে আবার সমর্থন করব, তবে দুটো জিনিস আর হবে না—
১. আপনাকে আর নেতা মানতে পারব না।
২. গতকালের সেই বৈঠককে কখনোই সমর্থন করতে পারব না।
বিশ্বাস করুন আপনাকে নিয়ে এটা আমার শেষ লেখা।”