ডা. কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ২৯ ডিসেম্বর: নতুন শালী ধান, নতুন অন্নকে কেন্দ্র করে গ্রাম-বাংলার যে সর্বজনীন উৎসব, তাই নবান্ন। ধরণীর উপহারে ‘ঋতুর খাঞ্চা’ তখন ভরে ওঠে, নবীন ধানের আঘ্রাণে মাৎ হয় অঘ্রাণ; মাঠে মাঠে আমন ধান পেকে ওঠার সোনালি শোভা। ‘গোবিন্দ ভোগ’ চালের পায়েস-পরমান্নের সুবাসে আর ‘গিন্নী পাগল’ চালের ফিরণীর ভুরভুরে গন্ধে; বিশ্বাস-সংস্কৃতির সঙ্গে লোকায়ত চিন্তন-পরিমন্ডলে এ এক অনবদ্য অনুষ্ঠান; আর তাতে পুরোটাই ‘মাটির গন্ধ’। কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘নবান্ন’ আর কাজী নজরুলের ‘অঘ্রাণের সওগাত’ কবিতায় তার অনবদ্য আঘ্রাণ।
নতুন ধান মুখে তোলার আগে ইষ্ট দেবতার কাছে উৎসর্গ করা হবে। নবীন ধানের ছড়ায় নানান অলঙ্কার বানিয়ে কৃষক তার বাড়ির দরজা অলঙ্করণ করবে। কৃষক বাড়ির উঠোন, মরাই তার জীর্ণতা দূরে সরিয়ে-সারিয়ে হয়ে উঠবে নান্দনিক। ধান্যলক্ষ্মী ঘরে আসছে ডালাভরা পাকা ফসল নিয়ে। “লেপিয়া আঙিনা দ্যায় আলপনা ভরা মরাই-এর পাশে,/ লক্ষ্মী বোধহয় বাণিজ্য ত্যজি এবার নিবসে চাষে।” অঘ্রাণ মাস নতুন ফসলের বার্তা বয়ে আনে, নতুন আশা; নতুন করে জীবনের জয়গান গেয়ে ওঠে পল্লীকবি। তখন কৃষকের গোলায় ধান আর গলায় গান — “প্রথম অগ্রহায়ণ মাসে নয়া হেউতি ধান।/ কেউ কাটে কেউ ঝাড়ে কেহ করে নবান।।”
আনন্দ এ কারণেই, ‘নবান্ন’ মানে খাদ্যের নিরাপত্তা। অন্নের ভান্ডার তখন পূর্ণ; দু’মুঠ অন্ন-সংস্থানের পরও জলপানের আনন্দ। নিরন্নের অন্নস্বপ্নের তখন যথার্থ লগ্ন। ক্ষুধার্তের কাছে তখন অন্নই দেবী লক্ষ্মীরূপে, অন্নদাত্রী অন্নপূর্ণা রূপে প্রকৃত আরাধ্যা, দয়াময়ী মাতৃরূপা। বাংলার প্রাণলীলার সকল ভিত্তি এই অঘ্রাণ, এই নবান্ন — “ওরে অগগেরান মাসেতে দ্যাশে জরমে নতুন ধান/ ওরে চিড়ামুড়ি দিয়া লোকে করেনও জলপান।” কিন্তু এমন আনন্দঘন দিবসেও বিরহী রাধার কুঞ্জে কৃষ্ণ যে আর আসবেন না। লোককবি তাই আনন্দের মাঝেও বিরহিণী রাধার দুখের বারোমাস্যার কথা বিস্মৃত হন না, “অঘ্রায়ণে নবান্ন হয় ঘরে ঘরে/ আমার কুঞ্জে নাই যে কৃষ্ণ অন্ন দিব কারে?”
নবান্ন উৎসব আসলে ধান্যলক্ষ্মীর আরাধনা। তারশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে লিখছেন, “…. কার্তিক সংক্রান্তির দিনে কল্যাণ করিয়া আড়াই মুঠা কাটিয়া আনিয়া লক্ষ্মীপূজা হইয়া গিয়াছে, এইবার লঘু ধানের চাল হইতে নানা উপকরণ তৈয়ারি করিয়া পিতৃলোক এবং দেবলোকের ভোগ দেওয়া হইবে। তাহার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে হইবে ধান্যলক্ষ্মীর পূজা।” ধান্যলক্ষ্মী বলেই তাঁর ধানের খোসার মত গায়ের রং হলদে। লক্ষ্মীর মত পশ্চিম সীমান্ত বাংলার টুসু মূর্তির রং হলদে, মাথায় মুকুট, দুই হাতে দুটি পদ্ম, সারা অঙ্গে নানা রকম গহনা। কৃষ্ণরাম দাস রচিত ‘কমলামঙ্গল’ কাব্যে দেবী লক্ষ্মীর আবরণ ও আভরণ হচ্ছে অজস্র রকমের ধান। কোনটি দেবীর পায়ের আলতা, কোনটি পাসুলি, কোনটি আবার গলার সাতনরী হার। দেবীর চুলের অলঙ্কার, সিঁথি থেকে পায়ের নুপূর সর্বত্রই ধানের অপরূপ ব্যবহার।
“পদাঙ্গে লক্ষ্মীর অঙ্গে আলতা পরিধানে।
কিরণ দেখিতে যেন আলতা সমানে।।
তবে তো কণকচূড় পরিলেন পাসুলি।
নুপূর গরুড়ধান্য সীতাভোগগুলি।।
বাঁকমল পাতামল কামিনী উজ্জ্বলে।
কিঙ্কিণী জামাইনাড়ু আর পদ্মদলে।।
খইহার ধান্যের মালা পরিল গলায়।
দেসুতি শীতলজিরে হরিভোগ তায়।।
পারিজাত ধান্যের পরিলা বক্ষহার।
ঊরুর উপরে পরেন বড় শোভা তার।।
সূর্যভোগ চন্দ্রমণি কোমরে পরিল।
নয়ানে অঞ্জন লক্ষ্মীকাজল করিল।।
মুক্তাশাল সিঁথায় সিঁন্দূর শোভা পায়।
করবী আঁটিল ধান্য কামিনীজটায়।।
লক্ষ্মীভোগ পুণ্যভোগ খোঁপায় রাখিল।
মুক্তঝুরি পাটখোপ পিঠেতে দুলিল।।”
‘বাংলার ব্রত” গ্রন্থে অবনীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, মেক্সিকোয় ফসল ঘরে তোলার মুখে ভুট্টার ছড় দিয়ে তারা গড়ে ‘ছড়া-মা’ মূর্তি। কিভাবে জগৎ পারাপার করে বাঙালীও তাদের ধানের দেবীকে ধান্য-অলঙ্কারেই সজ্জিত করেন। লক্ষ্মী-সাধনার এ এক বিশ্বরূপ।

বরিশালের একটি ছড়ায় পাই,
“কো কো কো, আমাগো বাড়ি শুভ নবান্ন/শুভ নবান্ন খাবা/কাক বলি লবা/পাতি কাউয়া লাহি খায়,/দাঁড় কাউয়া কলা খায়,/কো কো কো, মোরগো বাড়ি শুভ নবান্ন।”
নবান্নের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে গ্রাম-বাংলার যৌথ-সংস্কৃতির হারানো-যোগসূত্র (Missing link)। নবান্নের সুস্বাদ পঞ্চভূতে উৎসর্গিত হয়, নিবেদিত হয় আদি পুরুষ, সত্যযুগের মুনি-ঋষি এবং পূর্বপুরুষদের। পরিবেশিত হয় গৃহের অতিথি নর-নারায়ণকে। খাওয়ানো হয় গাই-বলদ, প্রকৃতির নানান জীবজন্তু – ঝোপের শেয়াল, গাছের পাখি, পুকুরের মাছ, গর্তের ইঁদুর, পিপড়ে, পোকা-মাকড়। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের দেবতা,বাস্তুতন্ত্রের জীবকূলকে খাইয়ে গৃহের আবাসিকেরা নবান্নের স্বাদ পান। আদতে দেবতা-পূর্বপুরুষের ভাগ ভাগাভাগি করে তো বন্যেরাই পায়। এ যেন ধান্য-সম্পদ রূপে পৃথিবীর ক্ষুধা-নিবৃত্তি। স্বর্ণাবরণ তূষের অভ্যন্তরে শস্যের শ্বেত-শান্তির মহান পূজা। গ্রাম-বাংলা নবান্ন কেন একেলা ভোগ করে না, কেনই বা থরে থরে সাজিয়ে তা প্রকৃতি মাতাকে উৎসর্গ করে, তার অধ্যাত্মিক তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। ‘নবান্ন’ প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, “…যেখানে উৎসর্গ নাই, দেবতার উদ্দেশে নিবেদন নাই, সেখানে অনিবার্য অতৃপ্তি, জ্বালাময় ভোগ-লালসা। নবান্নের অন্ন আমরা একা গ্রহণ করি না। আত্নীয়-স্বজনকে দিই, পাড়া-প্রতিবাসীকে বিলাই, গ্রামের সকলকে সাধিয়া বিতরণ করি, পশু-পক্ষী, কীট-পতঙ্গ সকলকে অর্পণ করি। কেন? না করিলে আমি পশু হইয়া যাইব। …আমার যে ক্ষুধা, তাহা যে বিশ্বেরও ক্ষুধা।”
রাঢ় বঙ্গের কোনো কোনো স্থানে যেমন কাটোয়া মহকুমায় নবান্ন উৎসবে কার্তিক পুজো হয়। এই কার্তিক ‘নবান্নে কার্তিক’। আসলে কার্তিকও কৃষি দেবতা। কৃষি-অরণ্য-পরিবেশের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে মা-দুর্গা ও তাঁর সন্তানদের। পরিচিতির আড়ালেও রয়েছে তাঁদের অন্যতর পরিচয়। সৌরদেবতা কার্তিক যুক্ত হয়েছেন উর্বরতাবাদের সঙ্গে। কার্তিক-ঊষার পুরাণ-কাহিনীও তাকে মান্যতা দিয়েছে। ঊষার শস্যক্ষেত্রে চির-অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কাহিনীতে রয়েছে সৌরশক্তি শস্যক্ষেত্রের উদ্ভিদদেহে ক্লোরোফিল সমৃদ্ধ সবুজ কলায় শোষিত হবার ঈঙ্গিত। কার্তিক যে উর্বরতাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তার অন্য একটি প্রমাণ হচ্ছে, এই পূজায় ব্যবহার হয় ‘অ্যাডোনিস গার্ডেন’-এর অনুরূপে চারাগাছপূর্ণ সরা। তাতে কার্তিকের প্রতীকরূপে পূজিত হয় গঙ্গামাটিতে অঙ্কুরিত ধান, ছোলা, মটর, কচু ও শুসনিশাক। উত্তরবঙ্গে কার্তিক সংক্রান্তিতে সারারাত ধরে যে গান ব্রতিনীরা পরিবেশন করেন তার বিষয় হল ফসলের কীটশত্রু,জীবজন্তু তাড়িয়ে দেবার কাহিনী। তাই মনে করা যেতে পারে, শস্য-রক্ষাকর্তা দেবতাকে তুষ্ট করে শস্য ঘরে তোলার জন্যই কাটোয়াতে ‘নবানে কার্তিক’ পূজিত হন।
কোথাও কোথাও নবান্ন উৎসব ‘চাল লবান’ আর ‘ভাত লবান’ — এই দু’ভাবে পালিত হয়। চাল-লবানে এক আশ্চর্য খাদ্য প্রস্তুতি চলে আগের দিন রাত থেকে। নতুন আতপ চাল ভিজিয়ে পরদিন তা ঢেঁকিতে আধকুটো করে তাতে মেশানো হয় খেজুর-গুড়, দুধ, খোয়া-ক্ষীর, মন্ডা, নানান ফলের টুকরো আর আদার কুচি। অপূর্ব সুস্বাদু এই খাবারের নাম ‘চাল-লবান’ বা চাল-নবান্ন। ভাত-লবানে নতুন চালের ভাত তৈরির গল্প। পুরনো চালে নতুন চাল মিশিয়ে ভাত রাঁধা হয়। আর চাষীর মেয়ে তা রাঁধতে রাঁধতে ছড়া কাটে,
“লয় পুরোনো শাড়ি চারি,/লয় পুরোনোয় বাকার বাঁদি,/নতুন রাদি পুরোনো খাই,/এই করে যেন জীবন যায়। লতুন বস্ত্র পুরোনো অন্ন,/এই যেন পাই জন্ম জন্ম।”
নবান্ন গ্রাম বাংলাকে মুখরিত করে তোলে। সকালে শিশু-বালক-বালিকার নানান লোকক্রীড়া; প্রবীণদের চন্ডীমন্ডপে আড্ডা; সন্ধ্যায় কবিগান, ভাসান গান তাকে মাধুর্যে ভরিয়ে তোলে। আর তার পরদিন অনুষ্ঠিত হয় ‘বাসি নবান’; তাতে আমিষের ঢালাও আয়োজন।

