সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, ৬ ফেব্রুয়ারি: এক রাতের মধ্যে যেন পাল্টে গেল গোটা ছবিটাই। বিয়ে বাড়ি ফেরত গৃহবধূকে অপহরণের চেষ্টা যেখানে শহরের নারী নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল। সেই ঘটনায় মৃত্যু হয় তার শ্বশুর গোপাল প্রামাণিকের। কিন্তু গোটা ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা বলেই দাবি পুলিশের। যদিও দুর্ঘটনা ঘটানোর অভিযোগে অ্যাম্বুল্যান্স চালক শেখ আবদুর রহমান এবং তার শালা তাজউদ্দিনকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশতলা ও বিষ্ণুপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যদিও তা মানতে নারাজ ওই বধূ এবং তাঁর প্রতিবেশিরা। প্রতিবাদে আজ তাঁরা হাতে টাকা নিয়ে পথ অবরোধ করেন।
পুলিশের দাবি, দুর্ঘটনা ঘটলেও মহিলাকে অপহরণ, শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের চেষ্টার মতো কোনও ঘটনাই ঘটেনি। মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতেও তা বলে গিয়েছেন গোপালবাবু। রাস্তায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে দ্রুতগতির অ্যাম্বুল্যান্স একটি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। বস্তুত, একদিকে মহিলার দায়ের করা অভিযোগ এবং পুলিশের দাবি মিলিয়ে ঘটনাটির রহস্য অন্য দিকে মোড় নিল বলেই দাবি করছেন অনেকে।
প্রাথমিক ভাবে বুধবার সকালে ট্যাংরার এক মহিলা থানায় এসে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। তিনি জানান, পূর্বাচল স্কুল মাঠ থেকে বিয়েবাড়ি রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ হেঁটে গোবিন্দ খটিক রোডে বাড়ির দিকে ফিরছিলেন। সঙ্গে ছিলেন মহিলার শ্বশুর এবং মামাশ্বশুর। আচমকাই একটি অ্যাম্বুল্যান্স এসে গোবিন্দ খটিক রোডেই জোর করে মহিলাকে গাড়িতে টেনে তোলার চেষ্টা করে। সেই সময় পুত্রবধূকে বাঁচাতে রুখে দাঁড়ান তাঁর শ্বশুর ও এক আত্মীয়। গোপালবাবু অ্যাম্বুল্যান্স চালককে গাড়ির জানলা দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে পরে কিছুটা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় অ্যাম্বুল্যান্স। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে এনআরএস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাত তিনটে নাগাদ সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। মহিলার আরও দাবি ছিল, রাতে ঘটনাস্থলে কোনও পুলিশ ছিলেন না। সকালে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে আসে।
ছবি: ঘুস দিতে চেয়ে টাকা নিয়ে বিক্ষোভ।
কিন্তু এখানেই সম্পূর্ণ আলাদা দাবি করেছেন তদন্তকারী আধিকারিকরা। লালবাজারের যুগ্ম-কমিশনার অপরাধ দমন মুরলীধর শর্মা বলেন, দুর্ঘটনাস্থলে পুলিশ না থাকলেও রাতেই খবর পেয়ে এনআরএস হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন অফিসাররা। সেখানে চিকিৎসার সময় চিকিৎসকের উপস্থিতিতে গোপাল বাবুর জবানবন্দি নেওয়া হয়। গোপালবাবু পুলিশকে জানিয়েছেন, বিয়ে বাড়ি থেকে ফেরার সময় তারা রাস্তার মাঝে গোল ভাবে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন। আচমকা একটা দ্রুত গতি অ্যাম্বুলেন্স তাঁকে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে যায়। এর ফলে তার ঘটনাস্থলেই পা ভেঙে যায় এবং সারা শরীরে আঘাত লাগে। তাই তিনি এম্বুলেন্স অ্যাম্বুল্যান্স চালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করছেন। এই জবানবন্দীতে গোপালবাবুর সই ছাড়াও চিকিৎসকের সই আছে। গোপালবাবু মারা যাওয়ায় এটাকে মৃত্যুকালীন জবান বন্দি’র হিসেবে বিবেচনা করে এর ভিত্তিতেই অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা রুজু করেছে পুলিশ।
একই সঙ্গে পুলিশের দাবি, ওই মহিলার বয়ানে অসঙ্গতি রয়েছে। ঘটনাস্থলের সাতটি সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখেছে পুলিশ। তাতে দেখা যাচ্ছে, অ্যাম্বুল্যান্সটি যেদিক এসে যে দিকে বেরিয়ে গিয়েছিল তাতে ওই মহিলাকে টানা হেঁচড়া করা সম্ভব নয়। আর যতটা দ্রুতগতিতে গাড়ি গিয়েছে এবং ওই ভদ্রলোক ছিটকে পড়েছেন, সেটাই ধরনের ঘটনা ঘটলে হতো না। গাড়িটিকে অতি অবশ্যই তার গতি কমাতে হত।কিন্তু সিসিটিভি ফুটেজ তা দেখাচ্ছে না। পুলিশের আরও দাবি, অভিযোগপত্র মহিলা নিজে লেখেননি, কেউ লিখে দেওয়ার পরে সেটি তিনি সই করেছেন। কারণ লেখার সময় কালির রং পরিবর্তন হয়েছে। তাই মহিলাকে জেরার সময় তার হাতের লেখাও পরীক্ষা করা হবে।
অন্যদিকে, অ্যাম্বুল্যান্স চালককে গ্রেফতার করার পর পুলিশ জানতে পেরেছে, এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে ট্যাংরার চিনা পাড়ায় একজন রোগীকে নামানোর পর বাড়ি যাবেন ঠিক করেছিলেন ধৃত আবদুর রহমান। কিন্তু আচমকাই বিদ্যাসাগর স্টেট জেনারেল হাসপাতাল থেকে তার ফোন আসে। তারপর তিনি দ্রুতগতিতে তপসিয়ার দিক থেকে সেন্ট জনস স্কুল পেরিয়ে মল্লিক বাজার পেরিয়ে ওই গোবিন্দ খটিক রোড দিয়ে বেরিয়ে যান। তখনই এই দুর্ঘটনাটি ঘটে।
এদিকে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ওই মহিলা। তাঁর দাবি, অপহরণ থেকে শ্লীলতাহানির ধারা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র বিষয়টিকে অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনার জেরে মৃত্যু বলে চেপে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এভাবেই রাতের শহরে নিরাপত্তার ফাঁকফোকর ঢাকতে চাইছে পুলিশ।
এর প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত হাতে টাকা নিয়ে গোবিন্দ খটিক রোডে পথ অবরোধ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রায় ১০০ জন বাসিন্দা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ স্লোগান দিতে থাকেন। তারা বলেন টাকা দিতে আমরাও তৈরি। ঘুস খেয়ে মিথ্যাকথা বলা বন্ধ করুক পুলিশ। তারা দাবি করেন, অপহরণ থেকে শ্লীলতাহানি এমনকি ধর্ষণের চেষ্টার ধারাও যোগ করতে হবে। যদিও পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে জানায়, প্রাথমিক অভিযোগের ভিত্তিতে ধারা দিয়ে মামলা রুজু করা হয়ে গেছে। এবার আদালতের বিচারে ধারা যোগ করা হবে। প্রয়োজন হলে সেখানে ওই মহিলা নিজের কথা জানাতে পারেন এবং তার সপক্ষে প্রমাণ দেখাতে পারেন। তার আগে আইনত আর ধারা যোগ করা সম্ভব নয়। এরপরেই পথ অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।
এখন প্রশ্ন হল, সত্যি কথা বলছে কে? সেভাবে তথ্যপ্রমাণ না পেয়ে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে পুলিশ নাকি তরুণী কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পুলিশকে বিভ্রান্ত করছেন? দুজন গ্রেফতার হলেও ট্যাংরা রহস্য যে এখনই সমাধান হল না, এই পরস্পরবিরোধী যুক্তি যেন সেটাই দেখিয়ে দিল।