পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের স্মৃতি (৮১) ঈশান ঘোষের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে ছিলেন নেতাজী

আমাদের ভারত, ২ এপ্রিল: বোয়ালমারীর খরসুতি গ্রামটি এখন বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়। কিন্তু তখন ছিলো যশোহর জেলাতে। এই গ্রামেই ঈশান চন্দ্র ঘোষের বাড়ি। বাড়ি মানে একসময় ছিলো। এখন এটি স্কুল। স্কুলও তাঁরই করা। মূল স্কুল, বাড়ি ও মন্দির নিয়েই এখন স্কুল কম্পাউন্ড।

ঈশান ঘোষ না ছিলেন জমিদার, না ছিলো তাঁর লবণ বা পাটের ব্যবসা। এতো কিছু কীভাবে করলেন? আর এমন পাকা বাড়ি করলেই তো নাম ছড়ায় না যে, মৃত্যুতে শোক জানাবেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর মতো ব্যক্তি। তাঁর মৃত্যুকালে (২৮/১০/১৯৩৫) নেতাজী ছিলেন ভিয়েনায়। মৃত্যু সংবাদ পেয়ে পুত্র প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ-কে পত্র লেখেন সেখান থেকে।

জঙ্গলাকীর্ণ প্রত্যন্ত পল্লীর প্রায় নিঃস্ব এক পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন ঈশান ঘোষ। এই ‘উঠে আসা’ বলতে বাড়ির এই দালানকোঠা নয়। এই ‘উঠে আসা’র ছবিখানা সুন্দর ফুটে উঠেছে নেতাজীর পত্রে উল্লেখ করা কটি বিশেষণে – ‘বিদ্বান, চরিত্রবান, সমাজ হিতৈষী’

১। এই জায়গায় পৌছতে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বাল্য কৈশোর আর যৌবনে ঈশান চন্দ্রকে প্রতিনিয়ত লিপ্ত থাকতে হয়েছে ক্ষিধে, দারিদ্র্য আর প্রতিকূলতার সাথে কঠিন জীবন সংগ্রামে। তাঁর জীবনের এমন কিছু দিক আছে চমৎকার মিলে যায় ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাথে। না, বিদ্যাসাগরের সাথে তুলনা করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। দু’জনেরই জন্ম ৪০ বছর আগে পরে। ঈশ্বর চন্দ্রের বিদ্যারম্ভ গাঁয়ের কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালায়। চার বৎসর পড়ানোর পর কালীকান্তই ঠাকুরদাস-কে বলেন, এখানকার পড়া শেষ। একে এখন কলকাতায় নিয়ে যান। ইংরেজি পড়াতে হবে।

ঈশান ঘোষ লিখেছেন, “আমি নিজে বিদ্যসাগরের নখের যুগ্যি না হলেও আমার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। আমার শিক্ষক ছিলেন ‘পইস্মের’ (পশ্চিমের ) বাড়ির সুরেশ জেঠু। আমার ৭ বছর বয়সে বাবাকে তিনি চিঠি লিখেছিলেন, ‘হৃষিকেশ, তোমার ছেলেকে এখন নিজের কাছে নিয়ে যাও। আমার পড়ানো শেষ।‘ বাস্তবে আমি স্কুলে ভর্তি হই পঞ্চম শ্রেণিতে।”

কিন্তু বিদ্যাসাগরের সময়ের ৪০ বছর পরও বর্ণপরিচয় শেখার সুযোগটি পর্যন্ত ছিলো না খরসূতিতে। তাই ঈশানকে যেতে হতো দূরের এক পাঠশালায়। ঈশ্বর, ঈশান, দুজনের পিতাই কাম কাজ করতেন প্রায় একই রকম। ঈশ্বরের বাবা ঠাকুরদাসের চাকুরী ছিলো কলকাতায় আর ঈশানের পিতা খাতা লেখার কাজ করতেন পাশের গাঁয়ের এক জোতদারের দোকানে। সেই সময়টাতে ঈশ্বরের পাঠশালা ছিলো মহা আনন্দের। ডানপিটে ঈশ্বর খেলতে খেলতে পাঠশালায় যেতো পাড়া অতিষ্ট করে। আর খালি পেটে আধ পেটা খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভিন গাঁয়ে পাঠাশালায় যেতো ঈশান। ক্লান্তিতে ঝিমুনি আসলে জিরোবার জন্য বসতো পথের এক মুদীর দোকানে। ক্লিস্ট মুখের বালকটিকে দেখে দয়াপরবশ হয়ে মুদী ধরিয়ে দিতো এক সিলিম তামাক। খিদে তাড়াতে ধরা সেই তামাক আর ছাড়াতে পারেননি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। শেষ বয়সে ধরে ক্ষয় রোগে। ক্ষয় রোগ মানে ‘যক্ষা’ এখনকার টিবি। তখন বলা হতো, ‘যার হয় যক্ষা, তাঁর নাই রক্ষা’। এই মরণ সময়েও বন্ধু সুহৃদ ও চিকিৎসক স্যার নীল রতন সরকারও ব্যর্থ হন ঈশান ঘোষের সাথে তাঁর আবাল্য সঙ্গী হুঁকা-গড়গড়ার বিচ্ছেদ ঘটাতে।

যে বয়সে (৯ বছর) বাবাকে হারান ঈশান, সেই বয়সে বাবার হাত ধরে ঈশ্বর রওনা দেন কলকাতা। উদ্দেশ্য ইংরেজিতে হাতেখড়ি। তবে যাত্রাপথেই ‘মাইল স্টোন’ দেখে বালক ঈশ্বর শিখে নেয় ইংরেজি, অংকের digit গুলি। কলকাতায় তখন সুযোগ ছিলো ইংরেজি শেখার। হেয়ার কি হিন্দু স্কুলে। ঈশ্বরের পিতা ঠাকুরদাসও না খেয়ে না দেয়ে টুকটাক ইংরেজি শিখেছিলেন ‘Yes, No, Very good, come, go, eat’ জানা দালালি করা এক বাউন্ডুলের কাছ থেকে। কিন্তু পুত্রের বেলা ঠাকুরদাসের অন্য ইচ্ছে। তাঁর নিজের পিতা ছিলেন পন্ডিত। তিনি হতে পারেননি। অপূর্ণ সেই ইচ্ছেটি পুরণ করে নেবেন পুত্রকে দিয়ে। তাঁর একান্ত ইচ্ছা, সংস্কৃত শিখে পন্ডিত হয়ে দেশে ফিরে টোল খুলবে ঈশ্বর। “চাকরি করে দুঃখ ঘুচাবে বলে আমি কলকাতা আনিনি।” তাই কলকাতায় এনে ঈশ্বরকে দেন সংস্কৃত কলেজে।

তবে এর ৪০ বছর পরও এই খরসূতির আশপাশে ‘মাইলস্টোন’ যে বসেনি, তা প্রায় নিশ্চিত। আর বসলেই বা কি? ঈশান তখন থাকা খাওয়া নিয়েই অকূল পাথারে। টেনেটুনে পাশ করে পঞ্চম শ্রেণি। কপাল গুণে আশ্রয় জুটে খরসূতি থেকে ৮/৯ মাইল দূরে বঙ্গেশ্বরদী গ্রামে এক বন্ধুর বাসায়। সেখানে ভর্তি হন ছাত্রবৃত্তি বা মাইনর স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে। এই প্রথম শ্রেণি ১০ ক্লাশ বিশিষ্ট স্কুলের পঞ্চম বা ষষ্ট শ্রেণির সমমান। যাক, এক বছরের মাঝে ১৮৭২ সালে ১৪ বছর বয়সে পাশ করেন ছাত্রবৃত্তি, সেই সাথে লাভ করেন বৃত্তি। এই সাফল্যই ছিলো ঈশান চন্দ্রের পরবর্তী সাফল্যের ভিত। এই বৃত্তি প্রাপ্তির কারণেই ভবিষ্যৎ জামাতা হিসাবে বালকটি নজরে পড়ে এক কন্যার পিতার। এই প্রথাটি, বিরল হলেও, এই সেদিনও ছিলো, কন্যাকে বিয়ে দেওয়ার শর্তে মেধাবী ছাত্রকে কন্যার বাবার পড়াশুনা করানোর প্রথা। আমার পরিচিত এক বড় ভাইয়ের গ্রেজুয়েশন হয় এই প্রক্রিয়ায়। “ভাবী শ্বশুরের বাড়িতে বছর খানেক থাকার পর ১৮৭৪ সালে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ঈশান চন্দ্র শশীমুখীকে বিবাহ করেন (৮ ই ফাল্গুন, ১২৮০)।“ এর পর আর পিছু ফিরতে হয়নি ঈশান-কে। একে একে কৃতিত্বের সাথে বৃত্তি নিয়ে পাশ করেন এন্ট্রেন্স, এফ এ (এখনকার এইচ এস সি)। শেষ জীবনটা প্রায় পুরো বিপরীত অবস্থার কথা বাদ দিলে ঈশ্বর চন্দ্র ও ঈশান চন্দ্রের কর্মজীবন, কর্মকান্ডে অদ্ভুত সাদৃশ্য নানান দিকে।

বৃত্তিসহ কলেজের শিক্ষা সমাপ্ত করে কিছুকাল গৃহশিক্ষকতা ও সংবাদপত্রে রচনাদি লিখে সংসার চালান। ১৮৮৫ খ্রি. সরকারি শিক্ষাবিভাগে যোগ দিয়ে বিভিন্ন স্কুলে প্রধান-শিক্ষকতা করার পর স্কুল ইন্‌স্পেক্টর হন। সংস্কৃত, ইংরেজী ও দর্শনশাস্ত্রে অসাধারণ পান্ডিত্য ছিল। কয়েকটি স্কুলপাঠ্য পুস্তক লিখলেও তাঁর লেখক-খ্যাতি পালি থেকে ‘বৌদ্ধ-জাতক’-এর অনুবাদক হিসাবে। বৃদ্ধ বয়সে পালি ভাষা শিখে একক চেষ্টায় ১৬ বছরে এই কাজ শেষ করেন। অনেকগুলি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের পরামর্শদাতা এবং কয়েকটির পরিচালক ছিলেন। বিভিন্ন জনহিতকর কাজে বহু আর্থ দান করেন। মাতা ও পিতার স্মৃতি রক্ষায় দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা, পুকুর খনন এবং রাস্তা ও মন্দির নির্মাণ করেন। যাদবপুর ও কসৌলী যক্ষ্মা হাসপাতালে অর্থদান করেছিলেন। ইংরেজী সাহিত্যের খ্যাতিনামা অধ্যাপক প্রফুল্ল চন্দ্র তাঁর জ্যৈষ্ঠপুত্র।

তথ্য সূত্রঃ শ্রী সুবোধ চন্দ্র সেনগুপ্ত। ২২ শে জৈষ্ঠ্য, ১২৮৪ ( এখন সাল চলছে ১৪২৯) ছবিঃ ঈশান চন্দ্র ঘোষের বাড়ি, খরসূতি, বোয়ালমারী, ২৭/০১/২০২৩

*১ “শ্রদ্ধাভাজনেষু সংবাদপত্র মারফত আপনার পিতৃসেবের স্বর্গারোহনের খবর জানিয়া খুব ব্যথিত হইলাম। তিনি বিদ্বান, চরিত্রবান ও সকল দিক দিয়া যোগ্য পুরুষ ছিলেন, তদ্ব্যতীত তাঁর সমাজ হিতৈষিতা সকলের গৌরবের বিষয় ছিল। ——- ইতি, বিনীত শ্রী সুভাষ চন্দ্র বসু’

সূত্র— পুরনো কলকাতার গল্প ফেসবুক গ্রুপ সৌজন্য: Tapan Roy
সূত্র— মহম্মদ কাইজারের পোস্ট পুরনো কলকাতার গল্প ফেসবুক গ্রুপ
সঙ্কলন— অশোক সেনগুপ্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *