অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, ৬ নভেম্বর: ভিটে–কে আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করেও পারলেন না…. “চতুর্দিকে তখন যা অবস্থা, তাতে আমার ভয় হল যে, বাড়িতে আমার মা-ভাই রয়েছে। যদি কিছু হয়! গ্রামে এসে বুঝলাম এখানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানো হচ্ছে। আমাদের পাশের গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং ইউনিয়ন মুসলিম লিগের নেতা হচ্ছেন এর মূল পান্ডা। কিন্তু ওঁর দাদা ইসমাইল ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। অমায়িক এবং অসাম্প্রদায়িক বিশিষ্ট ভদ্রলোক। আমার বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আমাকে খুবই ভালবাসতেন।”
দেশভাগ-পরবর্তী অবস্থার কথা এই ভাষাতেই বর্ণনা করছেন নারায়ণ বসু। কে তিনি? তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে ২০০২-এর ২৫ ডিসেম্বর প্রাবন্ধিক হোসেনুর রহমান লিখেছেন, “বিগত ৪০ বছর সংবাদপত্র জগতের অতন্দ্র প্রহরী, সাংবাদিক, সম্পাদক, বর্তমানে সংবাদ প্রতিদিনের ডিরেক্টর নারায়ণ বসু। একদিন বরিশাল থেকে প্রাণ হাতে নিয়ে কলকাতায় শিয়ালদহ ষ্টেশনে এসে নতুন জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হন।….. কম বয়সেই অহিংস সত্যাগ্রহীর সর্বোদয়ী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ হয়েছিলেন। প্রত্যক্ষ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যার তিনি শিকার হয়েছেন, হয়েছেন তাঁর মা ও বোনেরা। পিতৃদেব কোনওমতেই মাতৃভূমি ছেড়ে আসতে চাননি।”
কিভাবে পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা তাঁদের ভিটেকে আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করেও পারেননি, তা ফুটে উঠেছে নারায়ণ বসুর লেখায়, যাকে হোসেনুর রহমানের লিখেছেন, “তাঁর ন্যায়, নিষ্ঠা, সততা, স্বাদেশিকতা এবং সর্বোপরি নিঃস্বার্থ সমাজসেবা কতদূর বিস্তৃত হতে পারে
বাবার মৃত্যুর বর্ণনা দিয়ে নারায়ণবাবু লিখেছেন, “বিকেলের মধ্যেই দাহ কাজ শেষ হয়ে গেল। তারপর নিয়ম অনুযায়ী যা যা করণীয় সবই করলাম। দু’দিনের ক্লান্তি সত্ত্বেও রাতে ঘুম হল না। আকাশ-পাতাল সব ভাবতে শুরু করলাম। এখন কী হবে? একদিকে প্রচুর বিষয়-সম্পত্তি যার হিসেব আমি কিছুই জানতাম না। আর এক দিকে পাকিস্তানে থাকা যাবে কি না সেই ভাবনা। পাকিস্তান হওয়ার পর বাবাকে অনেকবার বলেছিলাম পশ্চিমবঙ্গে অন্তত ছোট একটা বাড়ি বানাতে, যাতে প্রয়োজন হলে এখানে এসে আশ্রয় নেওয়া যায়। কিন্তু বাবা কিছুতেই রাজি হননি। তাঁর বিষয় সম্পত্তি, বাড়িঘর ফেলে তিনি আসবেন না। তখনও তিনি ভাবতে পারেননি যে, ওখানে এমন একটা সময় আসবে যখন আর থাকা যাবে না। এখন তো তিনি সে-সব ভাবনার ঊর্ধ্বে চলে গেছেন।”
কিন্তু কেন দেশভাগের পর দলে দলে হিন্দুরা পূর্ববঙ্গের ভিটে ছেড়ে এপার বাংলায় চলে এলেন? বা, আসতে বাধ্য হলেন। সেই ছবি ফুটে উঠেছে নারায়ণবাবুর লেখায়— “৩০ ফেব্রুয়ারি বরিশাল শহরে দাগা শুরু হয়ে যায়। ১৪ তারিখ অনেক বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং বহু মানুষ মারা যায়। ১৫ ফেব্রুয়ারি শহরের বাইরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। মুলাদি, মাধব পাশা, লাকুটিয়া, কাশীপুর প্রভৃতি গ্রাম আক্রান্ত হয় এবং অনেক বাড়িঘর লুঠ হয় এবং অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। কত মানুষ নিহত হয়েছিল। তার সঠিক হিসেব কোনও দিনই পাওয়া যাবে না।
আমাদের পাশের গ্রামের এক মুসলমান দফাদার (নামটা মনে নেই) সন্ধ্যায় এসে আমাকে বললেন যে, অবস্থা খুব ভাল না। এখান থেকে চলে যাওয়াই ভাল। নইলে কী হবে বলা যায় না। ওইদিনই কিছু পরে ওই গ্রামেরই আমার এক মুসলমান বন্ধু হবিবুর রহমান (যদিও বয়সে আমার চেয়ে কিছু বেশিই ছিল) এসে খবর দিল যে, ওই রাতেই আমাদের বাড়ি আক্রান্ত হবে। আমাকে একটুও ভাবার সময় না দিয়ে সে আমাকে নিয়ে গেল তাদের বাড়িতে। আমি প্রথমে যেতে চাইছিলাম না, কারণ বাড়িতে তখন আমার দুই মা, ছোট বোন ও ছোট ভাই রয়েছে। তাদের ফেলে কী করে যাব। কিন্তু হাবিব বলল যে, এদের আক্রমণের লক্ষ্য আমি। আমাকে মেরে ওরা সমস্ত সম্পত্তি লুঠ করবে।
তখন পরামর্শ করার মতো কোনও লোক আমার কাছে ছিল না। তাই, কিছুটা ভয়ে, কিছুটা হাবিবের জবরদস্তিতে আমি ওর সঙ্গে রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে চলে গেলাম ওদের বাড়িতে। পথে ভাবতে-ভাবতে গেলাম যে এরা কোনও চক্রান্ত করছে না তো। ওদের গ্রামে আর একজন ছিল, নাম তার আব্দুল আলি। তার সঙ্গেও আমার খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। তাকেও হাবিব খবর দিয়ে ওর বাড়িতে নিয়ে এল পরামর্শ করার জন্য। তারিখটা ছিল ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০।
বাড়ি ছেড়ে চলে আসার আগে বাড়িতে দুর্গাপুজোর সময় পাঁঠা বলি দেওয়ার একটা বিরাট ‘রামদা’ ছিল সেটা এবং বাড়িতে যত বড় বড় তামা-পিতলের সব বাসন ছিল (পুজোর সময় ব্যবহারের জন্য) সেগুলি পাশের একটা পুকুরের জলে ফেলে দিলাম। যাওয়ার সময় বাড়ির সবাইকে বলে গেলাম যে, যদি হামলা হয় তবে কোনওরকম বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবে না। বাড়ি ছেড়ে পেছনের দিকে একটা বাগান ছিল আমাদের। সেই বাগানের পর গ্রামের দুটো হিন্দুর বাড়ি ছিল সেখানে চলে যাবে। ওই যে বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম তারপর আর কোনওদিন ওই বাড়িতে আমি আজ পর্যন্তও যাইনি। যদিও অনেক সুযোগ হয়েছিল।“ (‘আত্মস্মৃতি, নারায়ণ বসু, পৃ ২৪)।

সঙ্গে বাড়ির ছবিটি ইতনা, লোহাগড়ায়। সাজ্জাদুর রশিদের পোস্ট ‘সেভ দি হেরিটেজেস অফ বাংলাদেশ’ গ্রুপে।
‘মনেপ্রাণে হিন্দুত্ববাদী’দের কাছে অনুরোধ। আমাদের সাহায্য করুন। খুব আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে সাড়ে পাঁচ বছর ধরে ২৫ জন রিপোর্টার, বাংলায় একমাত্র আমরাই প্রতিদিন এই ধরণের খবর করছি। 🙏
ব্যাঙ্ক একাউন্ট এবং ফোনপে কোড:
Axis Bank
Pradip Kumar Das
A/c. 917010053734837
IFSC. UTIB0002785
PhonePay. 9433792557
PhonePay code. pradipdas241@ybl

