পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের স্মৃতি (২২), দুবলাহাটি রাজবাড়ি, অবহেলা অযত্নে ধ্বংসের দ্বারপ্রন্তে দাঁড়িয়ে

আমাদের ভারত, ৪ নভেম্বর: ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিসের কাছ থেকে ১৪ লক্ষ ৪ শত ৯৫ টাকা দিয়ে দুবলাহাটি এলাকার পত্তন নিয়ে জমিদারী পরিচালনা শুরু করেন জমিদার কৃষ্ণনাথ। কৃষ্ণনাথের কোনও পুত্র সন্তান না থাকায় তাঁর কন্যার পুত্র (নাতি) হরনাথ রায় ১৮৫৩ সালের জমিদারীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই হরনাথ রায়ের সময়েই দুবলাহাটি রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। এসময় তিনি দুবলহাটি রাজ প্রাসাদের সৈৗন্দর্য বৃদ্ধি, নাট্যশালা নির্মাণ ও প্রজা সাধারনের সুপেয় পানীয় জলের কষ্ট দূর করার জন্য রাজ প্রাসাদের পাশে অনেক পুকুর খনন করেন।

হরনাথ রায় চৌধুরী ও তাঁর পুত্র কৃঙ্করীনাথ রায় চৌধুরীর সময় এর ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়। প্রাসাদের বাইরে ছিল দীঘি, মন্দির, স্কুল, দাতব্য চিকিৎসালয়, ১৬ চাকার রথসহ বিভিন্ন স্থাপনা। প্রাসাদের ভেতরে ও বাইরে ছিল নাটক এবং যাত্রামঞ্চ। সেখানে নিয়মিত নাটক ও যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হতো।

জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি হওয়ার পর হরনাথ রায় স্বপরিবারে চলে যান ভারতে। এই জমিদার বংশের স্মৃতি স্বরূপ থেকে যায় বিশাল সুরম্য অট্টালিকা যার নাম হয় দুবলাহাটি জমিদার বাড়ি তথা রাজবাড়ি। ইট-সুরকিতে নির্মিত এ বাড়িতে আছে সুরম্য প্রাসাদ, দুর্গা মন্দির, রঙ্গমঞ্চ। বাড়ির মূল ভবনটিতে কমপক্ষে একশটি কক্ষ আছে। এছাড়া কারুকাজময় বারান্দা, রঙিন কাচের অলংকরণ, নানা ধরনের ভাস্কর্য এ জমিদার বাড়ির প্রধান আকর্ষণ। পরর্তীতে এটি সরকারী সম্পদ হিসাবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ দেখভালের দায়িত্ব নেয় এবং বর্তমানে এটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনেই রয়েছে।

রাজবাড়ির ধংসাবশেষ দেখে বোঝা যায় অনায়াসে। রাজ্যের বিস্তারে এলাকায় ব্যাপক প্রভাব ছিলো এ রাজ পরিবারের। হরনাথ রায় চৌধুরী রাজা খেতাব পেয়েছিলেন। এর আগে পূর্ব পুরুষরা মোগলদের দেওয়া জমিদার খেতাবে ভূষিত ছিলেন। রাজ পরিবারের গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে অন্তর্ভূক্ত “২২ কাহন কৈ মাছ” দিয়ে রাজস্ব প্রদানের স্বীকৃতি রয়েছে।

বর্তমানে রাজবাড়ির গেটের পাশে ছিন্নমূল বাবুর পরিবারের আবাস। রাজবাড়ির দুতলায় তিন-চার বছর ধরে দখল করে কবুতর পালন করছেন স্থানীয় যুবক আলম। জমিদারির বিলুপ্তির পর সরকার রাজবাড়িকে সরকারি সম্পদ হিসেবে প্রততত্ব বিভাগের অধীনে নেয়। প্রত্নতত্ব বিভাগ দায়িত্বভার নিলেও অদ্যাবধি এর সুরক্ষা বা সংস্কারের কোনও প্রকার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। স্থানীয় প্রভাবশালীদের কবলে পরে দিনে দিনে রাজবাড়ির মূল্যবান সম্পদ চুরি ও লুট হয়ে যায়। মূল্যবান দরজা, জানালা, শাল কাঠের তীর লুট করে নিয়ে যাওয়ার পর এখন দালানের ইট খুলে নিয়ে এলাকায় অনেকেরই বাড়ি তৈরী হবার কথাও প্রচলিত রয়েছে। অবহেলা অযত্নে ধ্বংসের দ্বারপ্রন্তে দাঁড়িয়ে থাকা দুবলহাটি রাজবাড়িতে এখন সকাল-সন্ধ্যা সব সময়ই চলে অসামাজিক কার্যকলাপ। অবাধে বসছে মদ, জুয়া, গাঁজার আড্ডা। এ রাজবাড়ি হয়ে উঠেছে উন্মুক্ত অসামাজিক কার্য কলাপের কেন্দ্র বিন্দু। কেউ দেখার নেই। কারোর মাথা ব্যাথা নেই। যার ফলশ্রুতিতে বর্তমানে ধংসের দ্বারপ্রান্তে দুবলহাটি রাজবাড়ি।

ঐতিহাসিক স্থাপনাটির সংস্কার করা হলে এই রাজবাড়িকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। রাজবাড়িটির অতি শীঘ্রই সংস্কার প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এই ঐতিহাসিক নির্দশন, বাংলার গৌরব উজ্জল ইতিহাসের সাক্ষী ঐতিহাসিক দুবলহাটি রাজবাড়ি সংস্কারে এগিয়ে আসা উচিত।

সূত্র— ‘দৈনিক আগামীর সময়’, ‘সামহোয়্যার ইন ব্লগ’ (বাঁধ ভাঙার আওয়াজ)।
সঙ্কলন— অশোক সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *