আমাদের ভারত, ২৬ মার্চ: বাঙ্গালি কেন জানিনা বিগত একশো বছরে মহা-ভারতের চাইতে নিজেদের আলাদা করে দেখতেই স্বচ্ছন্দ হয়েছে। নিজেরা অতি উৎকৃষ্ট প্রতিপন্ন করাটাও যে সংহতির বিপ্রতীপে একটা ‘রোগ’, তাও বোধহয় ঠিক মতো বুঝতে পারিনি। “What Bengal thinks today, India thinks tomorrow” সুবচনটি আমাদের আত্মম্ভরি করে তুলেছে, অথচ সময়ে সময়ে নিজের ওজন মেপে দেখিনি। বাঙ্গালির কল্পনায় শ্রীরামচন্দ্রের রূপ কেমন, সম্প্রতি আমি এক তরুণ শিল্পীর সঙ্গে আলোচনা করছিলাম। বাঙ্গালির কাছ থেকে শ্রীরামচন্দ্রকে প্রায় একশো বছরের জন্য কেড়ে নিয়েছে সমকালীন রাজনৈতিক দল এবং হিন্দু বিরোধী সংগঠনগুলি। তবুও যে শ্রীরামের প্রত্ন-প্রতিমা বাঙ্গালি হৃদয়ে অনুপম মূর্তিতে জেগে ছিল, জেগে আছে, তা আঁকবার চেষ্টা করেছেন শিল্পী শীর্ষ আচার্য। তা দেখানোর পরই আমাদের প্রস্তুত আলোচনা।
রবি ঠাকুরের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি পাঠ করেছি। ওখানে ‘রামধনু’-ই লেখা আছে, ‘রঙধনু’ নয়! “কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া,/রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া,/ রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া দিব রে পরান ঢালি।” যদি বলো তবে, “ফিরিব বাতাস বেয়ে/ রামধনু খুঁজি/ আলোর অশোক ফুল/ চুলে দেবো গুঁজি।” তোমার রামধনু চাই? বৃহৎ আকাশের সেই ধনুক চাই? শ্রীরামচন্দ্রের জন্মের আগেও এই Celestial event ছিল, আগামী দিনেও থাকবে। থাকবে সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, লোকায়তিক চেতনায়– ‘রামধনু’ হয়ে। তবুও ওরা ‘রামধনু’ বলবে না। যারা ‘রাম’-কে অশ্রদ্ধা করে, অবমাননা করে, তারা ‘রঙধনু’ বলে। তারা বাংলার শিকড় সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত, শব্দ-জেহাদী। ‘রাম’ মানে বৃহৎ, বিরাট। ‘রাম’ মানে অসীম, সীমানায় আবদ্ধ করা যায় না যাকে। রাম মানে সেই সত্তা, যা সবকিছুই রমণীয় করে তোলে, যা মনের আনন্দ, যা প্রাণের আরাম।
রাজা হিসাবে রাম কেমন রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতাতে দেখিয়ে দিয়েছেন, “. . . কহো মোরে, বীর্য কার ক্ষমারে করে না অতিক্রম,
কাহার চরিত ঘেরি সুকঠিন ধর্মের নিয়ম
ধরেছে সুন্দর কান্তি মাণিক্যের অঙ্গদের মতো,
মহৈশ্বর্যে আছে নম্র, মহাদৈন্যে কে হয় নি নত,
সম্পদে কে থাকে ভয়ে, বিপদে কে একান্ত নির্ভীক,
কে পেয়েছে সব চেয়ে, কে দিয়েছে তাহার অধিক,
কে লয়েছে নিজ শিরে রাজভালে মুকুটের সম
সবিনয়ে সগৌরবে ধরা মাঝে দুঃখ মহত্তম ——-
কহো মোরে সর্বদর্শী হে দেবর্ষি তাঁর পুণ্য নাম।”
নারদ কহিলা ধীরে, “অযোধ্যার রঘুপতি রাম।”
কবিতাটির মধ্যে বাঙ্গালি-সুলভ রামের প্রত্ন-প্রতিমা বা আর্কেটাইপ আঁকা হয়ে যায় বিশুদ্ধ বয়নে।
ভারতবর্ষের আদর্শ রাজা রাম। বাঙ্গালিরও। আমরা সুশাসন বলতে ‘রামরাজ্য’ কথাটি ব্যবহার করি। শ্রীরামের সুশাসনের কাহিনী এক বিস্তীর্ণ ভৌগোলিক এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল বলেই নানান জায়গায় মন্দির গাত্রে, প্রস্তরখন্ডে রাম-সীতা উপস্থাপিত হয়েছেন শিল্পীর নন্দনতত্ত্বে। মৌখিক সাহিত্য, শিকড় সংস্কৃতি থেকে রামকাহিনী মুছে ফেলা সম্ভব হয় নি। এ অমোচ্য, এ অপরিবর্তনীয়।
স্কুলে ছাত্রীদের সিস্টার নিবেদিতা একবার জিজ্ঞাসা করলেন, ভারতবর্ষের রানী কে? ছাত্রীরা জানাল, কুইন ভিক্টোরিয়া। নিবেদিতা রাগে ক্ষোভে দুঃখে উত্তেজিত। ধিক্কার দিয়ে সরোষে বলে উঠলেন, “ভারতবর্ষের রানী কে তাও তোমরা জান না? ইংল্যান্ডের অধীশ্বরী কুইন ভিক্টোরিয়া কখনই তোমাদের রানী হতে পারেন না। তোমাদের রানী সীতা। ভারতবর্ষের চিরকালের রানী সীতা।” একইভাবে ভারতবর্ষের চিরকালের রাজা রাম। রাজা রাম সার্বভৌম সম্রাট, মনের রাজা। বনবাসী, গিরিবাসী জনজাতির সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল অচ্ছেদ্য।
১৮৮৬ সালের ৭ ই জানুয়ারি; তখনও নরেন্দ্রনাথ স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে ওঠেন নি। কল্পতরু দিবস অতিবাহিত হয়ে গেছে (১৮৮৬ সালের ১ লা জানুয়ারি); শ্রীরামকৃষ্ণ তখন খুব অসুস্থ। তাঁকে নরেন্দ্রনাথ বলছেন, এখন থেকে তাকে প্রত্যহ বলে দিতে হবে সেদিন সাধন ভজন কীভাবে করবেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সেদিন তাঁর আদরের নরেনকে নিজের কুলদেবতা রামের ইষ্টমন্ত্র দিলেন। নরেনকে শক্তিমান পুরুষ, ধর্মযোদ্ধা, ন্যায়-পরায়ণ হয়ে ওঠার জন্যই রামনামে আবিষ্ট করেছিলেন সেদিন। পিতৃসত্য পালনের জন্য শ্রীরাম বনবাসী হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর ক্ষাত্রধর্ম অক্ষুণ্ণই ছিল। বনবাসী জীবনে কখনও অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ রাখেন নি রাম। যখনই প্রয়োজন হয়েছে অস্ত্র চালাতে দ্বিধা করেননি। শ্রীরামচন্দ্র কেনই বা অস্ত্র পরিত্যাগ করবেন! এ যে ক্ষাত্রধর্ম! শ্রীরামের এই অনন্য রূপের মধ্যেই রয়েছে চিরন্তন ভারতবর্ষের চিন্তন; শৌর্যশালী অথচ চির-তপস্বী । তপোবনে ভারতীয় সভ্যতার অনন্য উপাচার আর নগর-রাজধানীতে বিক্রমশালী প্রজারঞ্জন রাজা — এ দুয়ের এক অমিত মেলবন্ধন ভগবান শ্রীরামচন্দ্র।
স্বামী বিবেকানন্দ যে বীর সন্ন্যাসী হয়ে উঠেছেন তা হয়তো এই রঘুবীরেরই সাধনায়। গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর প্রিয় শিষ্যকে কুলের ইষ্টনাম দিয়ে সেই সাধনার ধারাকে পরিপুষ্ট করেছেন, বাঙ্গলাতে শ্রীরামকে পুনরুজ্জীবিত করে গেছেন। ১৩ ই জানুয়ারি, ১৮৮৬ সালে শ্রীম (মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত) দেখছেন, নরেন্দ্রনাথ পাগলের মতো রামনাম গাইছেন; অবশেষে ১৬ ই জানুয়ারি নরেনকে শ্রীরাম সন্ন্যাসীবেশে দর্শন দিলেন। ১৯ শে জানুয়ারি নরেন্দ্রনাথসহ নিরঞ্জন প্রমুখ সেই সন্ন্যাসী-রূপী রামের মতো রামাইৎ সাধুর বেশ ধারণ করলেন। নরেন যে সপার্ষদ সন্ন্যাসী হতে চান এবং তা ক্ষত্রিয় রামের সন্ন্যাস-বেশী রূপে তা তিনি বুঝিয়ে দিলেন।
রামায়ণের অসম্পূর্ণতা প্রমাণ করবার জন্য মহাশ্বেতা দেবী লিখছেন, “কৃত্তিবাসের রামায়ণে আলাদা করে কোনো অন্ত্যজ ভাবনা থাকতে পারে না। তিনি সংস্কৃত রামায়ণ অসামান্য ভাষায় ও ছন্দে বাংলায় লিখেছিলেন মাত্র।” (মহাশ্বেতা দেবী, ১৩৯৫, কৃত্তিবাসের রামায়ণে অন্ত্যজ ভাবনা, কবি কৃত্তিবাস সংকলন গ্রন্থ, ফুলিয়া-বয়রা, নদীয়া, পৃষ্ঠা ১৫১)। কিন্তু সত্যিই কী তাই?
১. শ্রীরামের সঙ্গে চণ্ডাল গুহকের মিতালি কবি কৃত্তিবাস যে ভাষায় আলোচনা করেছেন, তার পর মহাশ্বেতা দেবী কিভাবে বলেন, কৃত্তিবাসে অন্ত্যজ ভাবনা অনুপস্থিত? কৃত্তিবাস লিখছেন, “চণ্ডাল বলিয়া যদি ঘৃণা কর মনে/পতিত পাবন নাম তবে কি কারণে।”
মনে রাখার মতো বিষয়, কৃত্তিবাস যখন এমন কথা লিখছেন, তখনও আবির্ভূত হন নি সাম্যবাদী, ভক্তি আন্দোলনের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ শ্রীচৈতন্যদেব। এমন শ্রুতকীর্তি মানুষকে নিয়ে মহাশ্বেতা দেবীর ‘সাড়েচ্ছয়ানা’ মন্তব্য আমাদের ব্যথিত করে।
২. সুগ্রীবের সঙ্গে শ্রীরামচন্দ্রের সখ্যতা, বানরকূলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কীসের ঈঙ্গিতবাহী?
৩. অন্ত্যজ শবরীর হাতে শ্রীরামচন্দ্র ফল গ্রহণ করছেন, সেই জায়গাতেও কৃত্তিবাস মুন্সিয়ানায় পরিচয় দিয়েছেন।
রামায়ণের শিকড় যে কতটা মজবুত তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে বনবাসী কৌমগোষ্ঠীর পুরাণকথাগুলিতে। একটি উদাহরণ দিই। বিরহড় লোককথা, ‘রাম-সীতা-হনুমান’ গল্প। সেখানে তেঁতুল আর খেজুর পাতার অভিযোজনের গল্প, তারমধ্যে শ্রীরামচন্দ্র সম্পৃক্ত। রাম-লক্ষ্মণ-সীতা বনে চলে গেল। সেখানে তারা ‘উথ্লু’ বিরহড়দের মতো যাযাবরের জীবন কাটাতে লাগল। থাকত পাতার ছাওয়া কুঁড়ে ঘরে। একবার একটা মস্ত বড় তেঁতুল গাছের তলায় ঘর তৈরি করল তারা। সেই সময় তেঁতুল গাছের পাতা ছিল মস্ত বড় বড়; ভেতর দিয়ে রোদ ঢুকতে পারত না। রাম ভাইকে বলল, আমরা বনবাসে এসেছি, এখানে কষ্টে থাকতে হবে, আরাম করা চলবে না। কিন্তু এই গাছের ছায়ায় আমরা সুখে আছি, আমাদের গায়ে রোদ বৃষ্টি লাগছে না। এটা তো ঠিক নয়। তুমি তীর মেরে পাতাগুলোকে চিরে দাও। লক্ষ্মণ তীর মেরে তেঁতুল পাতাগুলোকে চিরে ফালাফালা করে দিল। একটা পাতা চিরে অনেক ছোট ছোট পাতা হয়ে গেল। সেই পাতার মধ্যে দিয়ে বৃষ্টির জল আর রোদের তাপ তাদের দেহে লাগল। সেইদিন থেকেই তেঁতুল পাতা এত ছোট ছোট হয়ে গেল। আবার চলেছে তিনজন বনপথ দিয়ে। এবার তারা ঘর তৈরি করল খেজুর গাছের নিচে। সেইকালে খেজুর পাতা ছিল খুব লম্বা আর চওড়া। বৃষ্টির জল আটকে দিত সেই পাতা। রাম আবার ভাইকে তীর ছুঁড়তে বলল। লক্ষ্মণ তীর মেরে খেজুর পাতাকে সরু সরু করে দিল। সেইদিন থেকে খেজুর পাতা সরু সরু হয়ে গেল। এই গল্পটি বনবাসী সমাজে প্রচলিত অনেকানেক গল্পের মতোই, যা প্রমাণ করে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী বনবাসী কৌমসমাজেরও উত্তরাধিকার।
কবে থেকে বাঙ্গালি রাম-নামে জারিত? কৃত্তিবাসের শ্রীরাম পাঁচালীর স্বাদ বাঙ্গালি পেয়েছে অন্তত ছ’শো বছর আগে। অনুমান করা যায় তার আগে থেকেই বাঙ্গলার প্রবুদ্ধ-মহলে সংস্কৃত বাল্মিকী-রামায়ণের চর্চা ছিল এবং লোককথায় তার অবিসংবাদিত বিস্তারও ছিল। লোকায়ত মানসে এমন শক্ত ভিত্তি না থাকলে কৃত্তিবাস এমন জনপ্রিয় ও লোকপ্রিয় রামায়ণ লিখতে প্রেরণা পেতেন না।
রবীন্দ্রনাথের মতে, বাঙ্গলা দেশে যে জনসাধারণকে একটা ভক্তির প্লাবনে প্লাবিত করে তুলেছিল; সেই ভক্তিধারার অভিষেকে উচ্চ-নীচ, জ্ঞানী মূর্খ, ধনী দরিদ্র, সকলেই এক আনন্দের মহাযজ্ঞে সম্মিলিত হয়েছিল — বাঙ্গলা রামায়ণ সেই ভক্তিযুগের সৃষ্টি।
মনে রাখতে হবে তুলসীদাসী ‘রামচরিতমানস’ লেখা হয়েছে কৃত্তিবাসী রামায়ণের অনেক পরে। সম্ভবত রাম জন্মভূমি-বিতর্কিত ধাঁচা বির্তকে বাঙ্গালিকে সামিল না করার ‘সেকুলারি-চালাকি’ করেছিলেন ‘অসত্য কথা-বলা ইতিহাসবেত্তারা’। শ্রীরামকৃষ্ণের কুলদেবতা ছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। স্বামী বিবেকানন্দের রাম-উপাসনা, রানী রাসমণির রঘুবীর-সাধনাকে বাঙ্গালি ভুলে গেছে। বাঙ্গালি কীভাবে ভুলে যায় মহামন্ত্র! “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ/ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।/ হরে রাম হরে রাম/রাম রাম হরে হরে।।”
রবীন্দ্রনাথের অধ্যয়ন নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তাদের লেখা থেকে জানা যায়, সবচাইতে বেশি দাগানো বই যা তিনি পড়েছিলেন এবং বিশ্বভারতী রবীন্দ্রভবনে আজও সংরক্ষিত আছে, তা হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত এবং নলিনীকান্ত ভট্টশালী সম্পাদিত (১৩৪৩) ‘কৃত্তিবাস রামায়ণ’। কৃত্তিবাসী রামায়ণ তাঁর জীবনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে তার পরিচয় আছে। রবীন্দ্রনাথের এক সম্পর্কিত দিদিমা-র মালিকানাধীন কৃত্তিবাসী রামায়ণের একটি বই ছিল। তা পড়তে গিয়ে করুণ বর্ণনায় তাঁর চোখ দিয়ে যখন টপটপ করে জল পড়ত, দিদিমা জোর করে তাঁর হাত থেকে বইটি কেড়ে নিয়ে যেতেন। রামায়ণ পড়ে কান্নার কথা ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধেও লিখেছেন তিনি। ভৃত্যশাসনে রবীন্দ্রনাথের পড়া বইগুলির অন্যতম হল কৃত্তিবাসী রামায়ণ। তার স্মৃতি সারা জীবনের জন্য তাঁর কাছে অহঙ্কার।
রবীন্দ্রনাথকে রামায়ণ সম্পর্কিত ‘মিথোম্যানিয়ায় আক্রান্ত’ হতে দেখি। ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থ ও ‘সহজপাঠ’-এ রবীন্দ্রনাথ শিশু মনকে রামায়ণে জারিত করে দিয়েছেন, “ওইখানে মা পুকুরপাড়ে/জিওল গাছের বেড়ার ধারে/হেথায় হবো বনবাসী/কেউ কোত্থাও নেই।” তিনি লিখছেন, এই রামায়ণ, মহাভারত আমাদের সমস্ত জাতির মনের খাদ্য ছিল। এই দুই মহাগ্রন্থই আমাদের মনুষ্যত্বকে দুর্গতি থেকে রক্ষা করে এসেছে। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠিতে লিখছেন, “কৃত্তিবাসের রামায়ণ যদি বাঙালি ছেলেমেয়েরা না পড়ে তবে তার চেয়ে শোচনীয় আশঙ্কা আমাদের পক্ষে আর কিছু হতে পারে না।”
রামায়ণ আছে রবীন্দ্র-সঙ্গীতে — “তোরা যে যা বলিস ভাই/আমার সোনার হরিণ চাই।” ‘রাম’ বলতেই ভারতীয় শিশুর কাছে এক অমোচ্য চিত্র ফুটে ওঠে। আর এই মিথোম্যানিয়ার জন্যই সহজপাঠ বইটি আজ অনেকের কাছে ব্রাত্য। শিশু কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ দু’ভাবে শিশুকে রামায়ণের সঙ্গে সংপৃক্ত করে দিচ্ছেন, নাম-বাচক শব্দে এবং প্রকৃতি চিত্রণে। কখনো নাম না বলেই শিশু রামায়ণের দেশে পাড়ি দিয়েছে — “মা গো, আমায় দে না কেন/একটি ছোটো ভাই –/দুইজনেতে মিলে আমরা/বনে চলে যাই।” নাম না করেও শিশু নিজের সঙ্গে শ্রীরামকে অভেদ কল্পনা করেছে। ছোটো ভাইটি যে সহোদর লক্ষ্মণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রকৃতি চিত্রণে রামের বনবাস-জীবন শিশুর কল্পনায় মুহূর্তেই চলে আসে — “চিত্রকূটের পাহাড়ে যাই/এমনি বরষাতে…”।
রাজপুত্রের বনবাসী হয়ে যাওয়া ভারতীয় শিশুর মানস-কল্পনায় কতটা প্রভাব এনেছিল, ‘সহজপাঠ’-এর একটি কবিতায় কবি তা এক লহমায় ধরে দিয়েছেন — “ঐখানে মা পুকুরপাড়ে /জিয়ল গাছের বেড়ার ধারে/হোথায় হব বনবাসী –/কেউ কোত্থাও নেই। কি বলবেন একে, মিথোম্যানিয়া নয়? রামায়ণ-ম্যানিয়া নয়! পারবেন তো এই শিকড়কে কেটে দিতে! আমার কিন্তু একজন রবীন্দ্রনাথ আছেন। আপনার?