ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ২৪ ডিসেম্বর:
শ্রীঅরবিন্দের বঙ্গপর্বের কাজ, তিনি তখন সাপ্তাহিক ‘ধর্ম’ পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। ১৯০৯ থেকে ১৯১০ সালের মধ্যে প্রকাশ করলেন ‘গীতার ভূমিকা’ সংক্রান্ত ধারাবাহিক কিছু লেখা। পরে পুস্তক আকারে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম ট্রাস্টের তরফে ১৯২০ সালে, তখন তিনি পণ্ডিচেরীতে রয়েছেন।
বইটিতে কী আলোচনা আছে তা জানাই। গ্রন্থটির প্রস্তাবনা অংশ শুরু হয়েছে এইভাবে, “গীতা জগতের শ্রেষ্ঠ ধর্মপুস্তক। গীতায় যে জ্ঞান সংক্ষেপে ব্যাখ্যাত হইয়াছে, সেই জ্ঞান চরম ও গুহ্যতম, গীতায় যে ধর্মনীতি প্রচারিত, সকল ধর্মনীতি সেই নীতির অন্তর্নিহিত এবং তাহার উপর প্রতিষ্ঠিত, গীতায় যে কর্মপন্থা প্রদর্শিত, সেই কর্মপন্থা উন্নতিমুখী জগতের সনাতন মার্গ।”
বইটির প্রস্তাবনা অংশে তিনটি ভাগ– বক্তা, পাত্র এবং অবস্থা। বক্তা হলেন শ্রীকৃষ্ণ। প্রস্তাবনার এই অংশে মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণকে কর্মবীর, মহাযোগী, মহাসংসারী, সাম্রাজ্যস্থাপক, রাজনীতিবিদ, যোদ্ধা ও ক্ষত্রিয়দেহে ব্রহ্মজ্ঞানী হিসাবে দেখানো হয়েছে। শাস্ত্রে রয়েছে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান, শ্রীকৃষ্ণ অবতার, মানবদেহে মানুষের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক ধর্ম গ্রহণ করে সেই অনুযায়ী লীলা করেছেন। গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে অবতারবাদ প্রচারিত; দশম অধ্যায়ে বিভূতিবাদ অবলম্বনে ভগবান সর্বভূতে অধিষ্ঠিত, শক্তিবিকাশের সামর্থ্যে কতিপয় বিশেষ ভূতে কতকাংশে ব্যক্ত আর শ্রীকৃষ্ণ রূপে পূর্ণাংশে অবতীর্ণ।
প্রস্তাবনার ‘পাত্র’ অংশ আলোচনায় দেখা যায়, শ্রীকৃষ্ণ-সখা মহাবীর অর্জুন গীতারূপ জ্ঞানের পাত্র, তিনি শ্রীকৃষ্ণের ভাই, প্রিয় সখা, পরম হিতৈষী বন্ধু এবং ভগ্নিপতি। ভগবান তাঁকেই গীতার পরম রহস্যের অমৃতবাণী শোনার জন্য বরণ করে নিলেন। সখা ও সহায় যিনি, তারই কাছ থেকে জ্ঞানলাভ করে অর্জুন যেন মানবজাতিকে তুলে দিলেন।
প্রস্তাবনার ‘অবস্থা’ অংশটি হল কুরুক্ষেত্রের অতি-ভীষণ হত্যাকাণ্ডের প্রারম্ভ। গীতোক্তির উদ্দেশ্য, কারণ ইত্যাদি বুঝতে গেলে তার কনটেক্সট জানা দরকার, কোন অবস্থায়, কোন পরিস্থিতিতে তা সংঘটিত হচ্ছে। অর্জুনকে দেশকালপাত্র বুঝিয়ে শ্রীকৃষ্ণ গীতোক্ত-জ্ঞান প্রকাশ করেছেন। স্থান যুদ্ধক্ষেত্র হলেও, মঞ্চ সৈন্যদ্বয়ের মধ্যস্থল হলেও, দেখা যাচ্ছে সেখানেই এর দীপ্ত-কথাচারণা। ভগবান কি, জগৎ কি, সংসার কি, ধর্মপথ কি, গীতায় তার সকল প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর দেওয়া হয়েছে। সন্ন্যাসশিক্ষা নয়, কর্মশিক্ষা হচ্ছে গীতার মূল উদ্দেশ্য।
গ্রন্থটিতে দু’টি অধ্যায়। প্রথম অধ্যায়ে যে যে বিষয়ে আলোচনা আছে তা হল সঞ্জয়ের দিব্যচক্ষুপ্রাপ্তি, দুর্যোধনের বাক-কৌশল, পূর্ব সূচনা, বিষাদের মূল কারণ, বৈষ্ণবী মায়ার আক্রমণ, বৈষ্ণবী মায়ার লক্ষণ, বৈষ্ণবী মায়ার ক্ষুদ্রতা, কুলনাশের কথা, বিদ্যা ও অবিদ্যা, শ্রীকৃষ্ণের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, ভ্রাতৃবধ ও কুলনাশ, শ্রীকৃষ্ণের রাজনীতির ফল। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের উত্তর, কৃপা ও দয়া, অর্জুনের শিক্ষাপ্রার্থনা, মৃত্যুর অসত্যতা, মাত্রা, সমভাব, সমতার গুণ এবং দুঃখজয় প্রসঙ্গ।
বইটির পরিশিষ্ট অংশে গীতার ধ্যান, সন্ন্যাস ও ত্যাগ এবং বিশ্বরূপ দর্শন (গীতায় বিশ্বরূপ, সাকার ও নিরাকার, বিশ্বরূপ, কারণজগতের রূপ এবং দিব্যচক্ষু) নিয়ে প্রবন্ধ সংকলিত রয়েছে।
গীতার ভূমিকায় শ্রীঅরবিন্দ লিখছেন, “গীতা অক্ষয় মণির আকর। যুগে যুগে আকরস্থ মণি যদি সংগ্রহ করা যায়, তথাপি ভবিষ্যৎ বংশধরগণ সর্বদা নূতন নূতন অমূল্য মণিমাণিক্য লাভ করিয়া হৃষ্ট ও বিস্মিত হইবেন।” ‘গীতার ভূমিকা’ শীর্ষক গ্রন্থের প্রস্তাবনায় রয়েছে, শ্রীকৃষ্ণ অবতীর্ণ হয়েছেন দ্বাপর ও কলিযুগের সংযোগস্থলে।
চতুর্যুগের মধ্যে কলিযুগ নিকৃষ্ট, কারণ এইযুগ মানুষের উৎকর্ষতার প্রধান শত্রু পাপপ্রবর্তকের রাজ্যকাল, অবনতি ও অধোগতির রাজ্যকাল। কলিযুগ যেন জ্যোতিষবিদ্যার একটি গ্রহের দশা যা অন্য সকল গ্রহের অন্তর্দশাভোগ। কলির দশায় যেন সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলির আপন অন্তর্দশাভোগ। কলিযুগ উৎকৃষ্ট একারণেই যে, বাধার বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে শক্তিবৃদ্ধি ঘটবে, জীর্ণ পুরাতন ধ্বংস হয়ে নতুনের আবির্ভাব ঘটবে। কলিকাল তাই নবায়নের কাল, নূতনের বীজ বপন ও অঙ্কুরোদগমের কাল। এই বীজ থেকেই মহীরূহ হবে সত্যযুগের বৃক্ষ। ঘোর অবনতির পরে উন্নতি চক্রগতিতে সম্পন্ন হবে, আর সেই সঙ্গে ভগবানের আপন অভিসন্ধিও সাধিত হবে। তাহলে যুগোপযোগী কী এমন আছে গীতাতে যা কলিযুগের পক্ষে ঋত ও সত্য?
শ্রীঅরবিন্দ বলছেন, গীতা শ্রীকৃষ্ণের বাঙময়ী মূর্তি। গীতার মধ্য দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ সত্যযুগ আগমনের উপযোগী গুহ্য জ্ঞান ও কর্মপ্রণালী রেখে গেছেন। অর্থাৎ আমরা বলতে পারি, গীতার বাণী হল সত্যযুগের মহালয়া বা আগমনীবার্তা। সত্যের আগমন কালে গীতাধর্মের বিশ্বব্যাপী প্রচার তাই অবশ্যম্ভাবী; গীতার বাণী পণ্ডিতদের ছাড়িয়েও সর্বসাধারণের মধ্যে প্রসারিত হবে।
গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে ৪৬ টি শ্লোকের বঙ্গানুবাদ রয়েছে। তারপর আলোচিত হয়েছে সঞ্জয়ের দিব্যচক্ষুপ্রাপ্তির বিষয়। রাজা ধৃতরাষ্ট্র দিব্যচক্ষুপ্রাপ্ত সঞ্জয়ের কাছে যুদ্ধের খবর নিচ্ছেন। এই দিব্যচক্ষুর কথা আধুনিক ভারতের ইংরাজী শিক্ষাপ্রাপ্ত শিক্ষিত লোকের চোখে কবির কল্পনা। কিন্তু শ্রীঅরবিন্দ বলছেন, “যদি বলিতাম অমুক লোক দূরদৃষ্টি (Clairvoyance) ও দূরশ্রবণ (Clairaudience) প্রাপ্ত হইয়া দূরস্থ রণক্ষেত্রের লোমহর্ষক দৃশ্য ও মহারথীগণের সিংহনাদ ইন্দ্রিয়গোচর করিতে পারিয়াছিলেন, তাহা হইলে বোধহয় কথাটি তত অবিশ্বাস্যযোগ্য না-ও হইতে পারিত।” বলেছেন, “যদি বলিতাম যে একজন বিখ্যাত য়ুরোপীয় বিজ্ঞানবিদ অমুক লোককে স্বপ্নাবস্থাপ্রাপ্ত (Hypnotised) করিয়া তাঁহার মুখে সেই দূর ঘটনার কতক বর্ণনা অবগত হইয়াছিলেন, তাহা হইলেই যাঁহারা পাশ্চাত্য hypnotism এর কথা মনোযোগের সহিত পড়িয়াছেন, তাঁহারা বিশ্বাস করিতেও পারিতেন।”
এই আলোচনায় শ্রীঅরবিন্দকে বলতে দেখা যায়, মানুষের মধ্যে এমন অনেক শক্তি নিহিত রয়েছে যা আগেকার দিনে সভ্য জাতি জানতো এবং বিকাশে সচেষ্ট হতো। কিন্তু কলিযুগে অজ্ঞানের স্রোতে সেই বিদ্যা একেবারে ভেসে গেছে। কেবলমাত্র অল্প কিছু মানুষের মধ্যে গুপ্ত ও গোপনীয় জ্ঞানরূপে রক্ষিত রয়েছে। শ্রীঅরবিন্দ লিখেছেন, সূক্ষ্মদৃষ্টির চরম পরিণাম হল দিব্যচক্ষু, যার প্রভাবে দূরের গোপনের বা অন্যলোকের জ্ঞান ও বিষয় আমাদের গোচর হয়। লিখছেন, “সূক্ষ্মদৃষ্টি বলিয়া স্থূল ইন্দ্রিয়াতীত সূক্ষ্মেন্দ্রিয় আছে যাহা দ্বারা আমরা স্থূল ইন্দ্রিয়ের আয়ত্তাতীত পদার্থ ও জ্ঞান আয়ত্ত করিতে পারি, সূক্ষ্ম বস্তু দর্শন, সূক্ষ্ম শব্দ শ্রবণ, সূক্ষ্ম গন্ধ আঘ্রাণ, সূক্ষ্ম পদার্থ স্পর্শ ও সূক্ষ্ম আহার আস্বাদ করিতে পারি।”
এই রকম আলোচনার পর শ্রীঅরবিন্দ বললেন, যোগশক্তির আধার মহামুনি ব্যাস এইরকম দিব্যচক্ষু সঞ্জয়কে দিতে সক্ষম ছিলেন যা অবিশ্বাস করার কারণ নেই। দিব্যচক্ষু বিষয়ক এই আলোচনার শেষে শ্রীঅরবিন্দের উপলব্ধি, মহাভারত রূপক নয়, কৃষ্ণ ও অর্জুনও কবির কল্পনা নয়, গীতাও আধুনিক তার্কিকের বিষয় নয়। তাঁর উপদেশ, গীতার সব কথা যে অসম্ভব নয়, যুক্তিবিরুদ্ধ নয়, তা প্রমাণ করতে হবে।