আমাদের ভারত, রামপুরহাট, ২১ নভেম্বর: সব দেবীর উর্দ্ধে মা তারা। তাই তারাপীঠে দেবী মূর্তি পুজোর কোনও চল নেই। তবে দেব পুজোয় কোন বাধা নেই। তাই তারাপীঠে নবান্ন উপলক্ষে দেব সেনাপতি কার্তিকের আরাধনায় মাতে তারাপীঠ। এই উপলক্ষে তারাপীঠে একাধিক জায়গায় কার্তিক পুজো করা হয়েছে। রয়েছে থিমের যুদ্ধ। নবান্নই তারাপীঠবাসীর বড় উৎসব। এবার চন্দননগরের আদলে কার্নিভ্যালের মাধ্যমে প্রতিমা নিরঞ্জন করা হবে।
নতুন ধানের অন্ন নবান্ন। মূলত গ্রাম বাংলার কৃষকরা নতুন ধান ঘরে তোলার আগে নবান্ন উৎসবে মাতেন। গ্রাম্যদেবতা এবং অন্নপূর্ণার পুজো না দিয়ে তারা নতুন অন্ন মুখে তোলেন না। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বনের মধ্যে নবান্ন বাঙালীর অন্যতম উৎসব। তারাপীঠের বাসিন্দাদের কাছে নবান্নই প্রধান উৎসব। নবান্নকে ঘিরে দেব সেনাপতি কার্তিক পুজোয় মাতেন তারাপীঠের বাসিন্দারা। তাই উৎসবের আনন্দ উপভোগ করতে তারাপীঠে দিন দিন বাড়ছে থিমের বাহার। নবান্ন উৎসব উপলক্ষে কার্তিক, শিব ও অসুরের মূর্তি গড়ে পুজো করেন তারাপীঠবাসী।
এবার তারাপীঠ মন্দির কমিটির কার্তিক পুজো ৫৯ বছরে পা দিল। তারাপীঠ তারামাতা সেবাইত সংঘের সম্পাদক ধ্রুব চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘মা তারা সব দেবীর উর্দ্ধে। দুর্গা থেকে জগদ্ধাত্রী, কালী থেকে লক্ষ্মী- সরস্বতী সব দেবীর পুজো হয় মা তারাকে সামনে রেখে। তাই এখানে কোনও দেবী মূর্তির পুজো করা হয় না। তবে দেব মূর্তি পুজোয় কোনও আপত্তি নেই। কার্তিক যেহেতু দেব সেনাপতি তাই কার্তিকের পুজো করা হয় নবান্ন উপলক্ষ্যে। এছাড়া শিব ও অসুরের মূর্তি গড়ে পুজো করা হয়।
একটা সময় ছিল তারাপীঠে কোনও মূর্তি পুজো হত না। নবান্ন হলেও তা বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে। সেসময় তারাপীঠের যুবকরা মূর্তি গড়ে পুজো করার জন্য ঝোঁক ধরে। নবান্ন উপলক্ষ্যে সাধারণত অন্নপূর্ণার পুজো করা হয়। কিন্তু অন্নপূর্ণা দেবী। তাই সেসময় প্রবীনরা বিধান দেন দেব মূর্তির পুজো করা যেতে পারে। সেই বিধান নিয়ে ১৯৬১ সালে তারাপীঠ মিলন সংঘ পাঠাগার নাম দিয়ে কার্তিক পুজো শুরু করা হয় দেব সেনাপতি হিসাবে। কার্তিকের পাশাপাশি গড়া হয় তারকাসুর ও শিব। কার্তিক তারকাসুরকে বধ করেছিলেন। আর শিব উপর থেকে বসে সেই যুদ্ধ দেখেছিলেন। তাই কার্তিকের পাশাপাশি শিব ও তারকাসুরের আরাধনা করা হয়”।
এবার মন্দির কমিটির পুজো উপলক্ষ্যে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। গোটা তারাপীঠ লাইটে সাজানো হয়েছে। চারদিন ধরে বহিরাগত শিল্পী দ্বারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। তারাপীঠ মন্দির কমিটির এবারের থিম হারিয়ে কাওয়া সময় বুনি, কাঠ পুতুলের গল্প শুনি। মণ্ডপ সাজানো হয়েছে থার্মকলের পুতুল দিয়ে”। তারাপীঠ রবীন্দ্রপল্লির এবার ২৪ বছরে পা দিল। সম্পূর্ণ ঝিনুক দিয়ে মূর্তি গড়া হয়েছে। মণ্ডপ গড়া হয়েছে রাজবারির আদলে।
পুজো কমিটির সম্পাদক ঝুলন দত্ত বলেন, ‘নবান্ন আমাদের কাছে প্রধান উৎসব। তাই আমরা মানুষকে আনন্দ দিতে নতুন নতুন থিমের আয়োজন করি। এবার দিঘা থেকে অর্ডার দিয়ে ঝিনুক আনা হয়েছে”। লেটপাড়া পালপাড়া সার্বজনীন পুজো কমিটির থিম করা হয়েছে বৃদ্ধাশ্রম। সেখানে একটি শিশু মাতৃক্রোড় থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে মা বাবা কে কিভাবে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাচ্ছে তা তুলে ধরা হয়েছে। পুজো কমিটির সদস্য বিশ্বনাথ লেট বলেন, “ছেলেরা বড় হয়ে মা বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়। এই প্রবণতা রোধ করতেই থিম করেছি। যদি কিছু মানুস্কেও সচেতন করতে পারি তাহলে আমাদের থিম করা সারথক হবে”।
তারাপীঠ সবজি বাজার কল্যাণ সমিতির থিম প্রকৃতি। চোরাকারবারিদের হাতে থেকে প্রকৃতিকে রক্ষা করতেই এই থিম করা হয়েছে বলে জানান পুজো কমিটির সদস্য দেবনাথ দাস। পাঁচদিনের এই উৎসবে সামিল হতে তারাপীঠের মেয়েরাও বাপের বাড়ি চলে আসেন। তারাও মাতেন কার্তিক পুজোর উৎসবে। নিরঞ্জনের দিন সিঁদুর খেলা হয় মহিলাদের মধ্যে। তারাপীঠে মা তারা তো রয়েছেনই। তবে এই চারটি দিন নবান্ন উপলক্ষ্যে তারাপীঠ এখন মেতেছে কার্তিক আরাধনায়।