স্বামী প্রৌঢ়ানন্দ
আমাদের ভারত, ২১ নভেম্বর: তীর্থে তীর্থে পথে পথে যে তীর্থ দেবতার করুনার স্পর্শ পাওয়া যায় তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ দিয়ে গেল অরুণ। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে প্রায় অর্দ্ধোন্মাদ হয়ে সে এখানে এসেছিল, জীবন তার কাছে অর্থহীন হয়ে গিয়েছিল, বেঁচে থাকার কোনও মানেই সে খুঁজে পাচ্ছিল না।তার উপর আবার দৈবদূর্বিপাকে পড়ে সে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়, ভবঘুরের মতন দিক্বিদিক শূন্য হয়ে ঘুরতে থাকে। চরম নৈরাশ্যের অন্ধকারে সে যখন নিমজ্জিত ঠিক তখনই মা তাকে আলোর নিশানা দেন। জীবনের মানে হারিয়ে ফেলা অরুণ উপলব্ধি করে জীবনের চরম সত্যকে। সত্যের আলোকশিখার সন্ধান পেয়ে জীবনের ছোট ছোট দুঃখ কষ্টগুলো তাঁর কাছে অর্থহীন হয়ে গেছ। এখন সে পেয়ে গেছে এক মহাজীবনের সন্ধান। জয় মা, তোমার লীলাখেলা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। আঁধারের মাঝে যে সত্যের আলোকশিখা লুকিয়ে থাকে তা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই, তাই তো আমরা আঁধারকে এত ভয় পাই।
কামাখ্যা ধামে আরো অনেক মন্দির আছে সেগুলি একটু পাঠকদের অবগতির জন্য জানাই-
উমানন্দ পাহাড়ের দক্ষিণ দিকে ব্রহ্মপুত্র নদের মাঝখানে রয়েছে ঊর্ব্বশীকুণ্ড। ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পারে উত্তর গুয়াহাটিতে রয়েছে অশ্বক্রান্ত–কুর্মরূপী বিষ্ণু এখানে অবস্থান করছেন। এই উত্তর গুয়াহাটিতেই মনিশৈল পর্বতে মনিকর্নেশ্বর নামক শিবলিঙ্গ রয়েছে। গুয়াহাটি উজান বাজারের পূর্ব সীমান্তে চিত্রাচল পাহাড়ের উপর নবগ্রহের মন্দির আছে। এককালে এটি ছিল জ্যোতিষ চর্চার প্রাণকেন্দ্র। এই পাহাড়ের থেকে একটু দূরে রয়েছে কণ্বাচল। কথিত আছে এখানে মহর্ষি কণ্বদেবের আশ্রম ছিল। উজান বাজারের জোড় পুকুরের পাড়ে অবস্থিত উগ্রতারা মন্দির।উজান বাজারের কাছে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে রয়েছে ছত্রাকার মন্দির। এটি একটি ছোট্ট পাহাড়ের উপর অবস্থিত। গুয়াহাটির মধ্যস্থলে পানবাজার নামক স্থানে একটি ছোট্ট পাহাড়ের উপর অবস্থিত শুক্রেশ্বর মন্দির। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য কর্তৃক এই শিবলিঙ্গ স্থাপিত হয়।শুক্রেশ্বরের নীচেই রয়েছে জনার্দন মন্দির। এখানে প্রভু বিষ্ণুর মূর্তি রয়েছে। জনার্দন মন্দিরের কাছেই রয়েছে বাণেশ্বর শিবের মন্দির। বরাহ পর্বতের নীচে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে রয়েছে পাণ্ডনাথ নামক প্রভু বিষ্ণুর মন্দির। এইখানে পঞ্চপাণ্ডবের মূর্তি স্থাপিত আছে।
গুয়াহাটি থেকে সাত মাইল দূরে অবস্থিত বশিষ্ঠ মুনির আশ্রম। এই জায়গাটি চারিদিকে পাহাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত। বেশ নিরিবিলি নির্জন জায়গা এটি। কথিত আছে মহর্ষি বশিষ্ঠদেব আপন তপঃপ্রভাবে সন্ধ্যা, ললিতা ও কান্তা এই ত্রিধারায় এখানে গঙ্গা আনয়ন করেছিলেন। বশিষ্ঠদেব প্রতিদিন এই ত্রিধারায় স্নান করতেন। সূর্য গ্রহণ ও চন্দ্র গ্রহণের সময় এখানে প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়। এই জল মাথায় নিয়ে প্রনাম জানালাম-
“সন্ধ্যাচলসমুদ্ভূতে বশিষ্ঠেনাবতারিতে।
কুরুক্ষেত্রে মম স্নানং গঙ্গাগর্ভ নমোহস্তুতে।।”
এই জায়গাটির এতো মনোরম পরিবেশে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। কিছুটা দূরে একটু জঙ্গলের মধ্যে একটা গাছের তলায় বসে পড়লাম জপ করার বাসনায়। ইতিমধ্যেই বেলা পড়ে এসেছে, একটা আলো-আঁধারির পরিবেশ। পদ্মাসনে বসে শুরু করলাম জপ। কিছুক্ষণ জপের পরই দেখি যে জায়গায় বসে আছি সেই স্থান অত্যন্ত গরম হয়ে উঠেছে, আর সেই তাপে আমার সর্বশরীর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। আমাকে যেন আসন থেকে এখনি উঠে যেতে হবে।মনে হচ্ছে এখুনি গিয়ে নদীর জলে ডুব দিই। কিন্তু না উঠে আমি আরও জোর করে জপকে আঁকড়ে ধরলাম। দেখি কার সাধ্যি আমাকে আসন থেকে টলায়। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর দেহ যেন একটু ঠান্ডা হল। কতক্ষণ এভাবে কেটেছে জানি না, যখন জ্ঞান ফিরে এল তখন দেখি চতুর্দিকে অন্ধকার। সেই নিবিড় অন্ধকারে সামনের কিছু ঠাহর করা মুশকিল। মাঝে মাঝেই ঠান্ডা বাতাস গায়ে এসে লাগছে। চারদিকে পাতার খস খস আওয়াজ, বুঝতে পারছি বন্য জন্তুরা চলা ফেরা করছে। ওদের মাঝে নতুন অতিথিকে দেখে ওরা আসব কি আসবব না বুঝতে পারছে না। হঠাৎ পায়ের কাছে অনুভব করলাম এক ঠান্ডা শীতল স্পর্শ ক্রমশ তা উপরে উঠে আসছে। বুঝতে পারলাম একটা সাপ গা বেয়ে উঠছে। চুপচাপ বসে রইলাম। খানিকটা পরে পিঠ বেয়ে সাপটা নেমে গেল। এখানে আর বসে থাকা ঠিক হবে না ভেবে অন্ধকার হাতড়ে নীচে নামার চেষ্টা করলাম।কিন্তু, এতে হল হিতে বিপরীত। অন্ধকারে পথ হারিয়ে আরও জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করলাম। পদে পদে হোঁচট খাচ্ছি, মনে মনে মাকে জানাচ্ছি একি তোমার লীলা মা! এই অধমকে কোন গলিতে এনে ফেললে! সমস্ত ভয় ভাবনা ত্যাগ করে মায়ের চরনে সব কিছু সমর্পণ করে জানালাম মা তোমার ইচ্ছাই পূর্ন হউক। জঙ্গলের মধ্যে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে এক জায়গায় দেখি দূর থেকে একটা আলোর শিখা দেখা যাচ্ছে। আলো লক্ষ্য করে কাছে গিয়ে দেখলাম লাল কাপড় পরা এক দীর্ঘদেহী সন্ন্যাসী ধূনী জ্বালিয়ে বসে আসেন, আর ধূনীর ওপারে বসে রয়েছে এক বিশাল সর্প।আরও আশ্চর্য ঐ বিশাল সর্পটি মাঝে মাঝেই নিজেকে ধূনীর আগুনে নিক্ষেপ করছে কিন্তু তার কিছুই হচ্ছে না। দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে আমি অবাক হয়ে দাড়িয়ে রইলাম।