কল্যাণ গৌতম
আমাদের ভারত,৪ জানুয়ারি:
বাজিতপুরের বাজিগর: তখনও রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবান্দোলনের গনগনে রোদ্দুর; তখনও ঠাকুর-মা-স্বামীজির সামীপ্যে আসা বহু মানুষ জীবিত; এমতাবস্থায় কেন প্রয়োজন ঘটলো আর একটি সন্ন্যাসী-সঙ্ঘের? “যত মত তত পথ”-এর বাণীতে বহুধা বিভক্ত হিন্দু সমাজের তো কাছে আসার কথা ছিল! তবে কেন হিন্দু সমাজকে ডাক দিয়ে ‘শক্তি-সংগঠন-সেবা-সমন্বয়-সংযম’-এর আদর্শে ফের তৈরি করতে হল ‘ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ’? তার কারণ হল, দেব-অসুরের দ্বন্দ্ব-সমাস। অমর-পথে আসুরিক শক্তি বা হিংস্র-মতের কথা থাকতে পারে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল যথার্থ হিন্দু সমাজ, কিন্তু কথার বিতর্কে তা ভেসে উঠতে পারেনি। এমন সময় বাংলায় নেমে এলো হিন্দুদের উপর বিধর্মীদের অন্যায়-অত্যাচার, তারপরে মুসলিম-লীগ শাসনে আনুষ্ঠানিক ধারাবাহিকতা। হিন্দুরা তাই নতুন করে ভাবতে শিখলো যাদের পথ কেবলই আসুরিক, যাদের কাছে হিন্দু মাত্রেই কাফের ও হিদেন, তাদের সর্বধর্ম সমন্বয় শেখানো নিতান্তই বাতুলতা!
ভারতবর্ষের মুসলমানেরা সেই সময় সঙ্ঘবদ্ধই ছিল, সুগঠিত ছিল ভারতীয় খ্রীষ্টানরাও, কেবল হিন্দুরা তখন ছিল অসার-অবশ হয়ে ঘুমিয়ে। যুগাচার্য প্রণবানন্দ বলছেন, “মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে কেউ অত্যাচারিত হলে সমগ্র সম্প্রদায় তার প্রতিকারে সচেষ্ট হয়। আর হিন্দুর মধ্যে সংহতি শক্তি নাই বলেই তো দুর্বৃত্তেরা অত্যাচার, উৎপীড়ন, নারীহরণ, নারীধর্ষণ করে রক্ষা পায়।” এমনই জাতিকে জাগিয়ে, তারই শাখা-প্রশাখাগুলিকে সমন্বিত করে হিন্দু জাগরণ ঘটালেন একজন ‘জাদুকর’, হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য কীর্তনীয়া, তিনি যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দ। বললেন, ভারতবর্ষকে যদি শক্তিশালী করতে হয়, তবে শক্তিশালী হিন্দু জাতির উত্থান ছাড়া তা সম্ভব নয়। বললেন, নানা জাতির মিলন সর্বদা সমানে-সমানে হওয়া উচিত, সবলে-দুর্বলে নয়। হিন্দুকে তাই সবল হতে হবে। হিন্দুর মধ্যে যখন সঙ্ঘ-শক্তি গড়ে উঠবে, এক হিন্দুর বিপদে সহস্র হিন্দু জান দিতে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়াবে তখন সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তগণ আপনা আপনিই সংযত, ত্রস্ত হয়ে যাবে। বললেন, “আমি সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করতে চাইনে, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী দুষ্টের দমন চাই।” ধর্মই বর্ম”, “হাতে কাম (কাজ), মুখে নাম”, ” মহামৃত্যু হল আত্মবিস্মৃতি” — যার এই বাণী, তিনি হলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রিয়পাত্র যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দ।
হিন্দুকে হিন্দু বলে ডাক দিলেন স্বামীজি। ফলে মূল্য চুকাতে হয়েছিল তাঁকে। হিন্দু-বিরোধী এবং স্বার্থান্বেষীরা তাঁকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে দেগে দিলেন; যেমন দেগে দিয়েছিলেন ‘বন্দেমাতরম-এর রচয়িতা বঙ্কিমচন্দ্রকে; যেমন দেগে দেওয়া হয়েছিল ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে। অথচ বঙ্কিম চিরকাল বুদ্ধিজীবীর সততা রক্ষা করে গেছেন, মুসলমানদের হিংসাত্মক কাজের কিছু সমালোচনা করলেও ইসলামের বিরুদ্ধে কখনও কিছু বলেননি। বঙ্কিম ইতিহাস বিকৃতি কখনও করেননি। একইভাবে শ্যামাপ্রসাদকে অসাম্প্রদায়িক বলে বর্ণনা করেছিলেন বাংলার তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কোনো ব্যক্তি যদি স্বধর্মানুরাগে হিন্দুদের জাগাতে চান, কোনো তাপস যদি সঙ্ঘশক্তিতে হিন্দুকে বাঁধতে চান, তবে তিনি সাম্প্রদায়িক কেন হবেন?
শতধা বিচ্ছিন্ন হিন্দু সমাজকে কেটে কেটে টুকরো করতে চেয়েছিল তখনকার ‘টুকরে-গ্যাং’, তাদের সাথে আপাত ফারাক ছিলো না রাজনীতির সুবিধাবাদী কিছু মানুষের, এ কাজে ফারাক করা গেলো না চতুর বুদ্ধিজীবীকে; তারা বরং হিন্দুদের বিভেদ বাড়িয়ে দিয়ে কোনও কোনও শাস্ত্রের দিকে আঙুল তুললো। হিন্দুদেরকে যথাসম্ভব শাস্ত্র-বিরোধী করতে সচেষ্ট হল তারা; অথচ দেখা গেলো শাস্ত্রে এমন কোনো কাজের নির্দেশ দেওয়া তো দূরের কথা, সমর্থনও নেই। এমতাবস্থায় অনাদি-অনন্ত হিন্দু জীবনচর্যার সাময়িক বিক্ষিপ্ততায়, নতশির জাতির সামনে উপস্থিত হলেন এক তাপস-শ্রেষ্ঠ।
কর্মযোগী শিবপুরুষ স্বামী প্রণবানন্দ হিন্দুদের দিয়ে গেলেন অকুতোভয় আত্মবিশ্বাসের সুর। হিন্দুধর্মের আহ্বান “শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা” তো আছেই; “অয়তু সর্বতো স্বাহা” তো ছিলই; এবার তিনি বলতে এলেন, “হিন্দু বিদ্যায় বড়, বুদ্ধিতে বড়, অর্থ সামর্থ্যেও সে কাহারও অপেক্ষা কম নয়। কিন্তু নাই কেবল সংহতি শক্তি। এই সংহতিশক্তির অভাবেই হিন্দু আজ সর্বত্র লাঞ্ছিত, নির্যাতিত। সর্বপ্রকার ভেদ-বৈষম্য, অনৈক্য-পার্থক্য, ঈর্ষা-দ্বেষ বিদূরিত করিয়া এই শতছিন্ন হিন্দু সমাজকে যদি আবার ঐক্য, সখ্য, প্রেম, প্রীতি ও মিলনের সূত্রে সম্মিলিত ও সঙ্ঘবদ্ধ করা যায়, তাহা হইলেই হিন্দু আবার তাহার সুপ্ত শক্তির পুনরুদ্ধার করিয়া জগতে অজেয় হইয়া দাঁড়াইতে পারিবে।”
তিনি বললেন, “আমি হিন্দুকে হিন্দু বলে ডাক দিতে চাই। আমি সমগ্র হিন্দু জনসাধারণকে ‘আমি হিন্দু, আমি হিন্দু, আমি হিন্দু’ জপ করাব।”
সেবা আর হিন্দু মিলন মন্দির নির্মাণের জন্যই স্বামী প্রণবানন্দজীর ধরায় আসা; হিন্দুরক্ষী দল গঠন করে আত্মরক্ষা, ক্ষাত্রশক্তি ও সংহতিবলের সঞ্চারের জন্যই তাঁর ধরাধামে আগমন। ব্যক্তি-পরিবার ও সমাজের সর্বপ্রকার সমস্যার সমাধান করতেই তিনি এসেছিলেন। সহস্র স্ব-জাতি সহস্র স্ব-ধর্মপ্রেমী কর্মী, শত শত ত্যাগী সন্ন্যাসীকে হিন্দু-ভাবনায় ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে তাঁর আবির্ভাব। তিনি মিলনের ঈশ্বর; সে মিলন হিন্দুত্বের, সে সমন্বয় সনাতনের, সে বাঁধন অখণ্ড ভারতবর্ষের — “শান্তিপুর ডুবুডুবু নদে ভেসে যায়/বাজিতপুর প্রাণের পুর, মিলনভূমি ভাই।”
ভারতীয় সভ্যতার এক যুগসন্ধিক্ষণে প্রণব-ধ্বনি বেজে উঠলো। স্বামী বিবেকানন্দের জীবসেবার বাণীকে যথাযথভাবে বাস্তবায়নের নাম ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ।
শ্যামাপ্রসাদ ও স্বামী প্রণবানন্দের নৈকট্য স্বামী প্রণবানন্দজীকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন বাংলার অনেক রাজনৈতিক নেতা। কিন্তু ধরা দেননি তিনি। ডা. প্রতাপ চন্দ্র গুহ রায় তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের; বললেন “ইনি স্বামী প্রণবানন্দ। অদ্ভুত সংগঠন শক্তি উনার। আপনি যদি একটু বুঝিয়ে উনাকে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে ভিড়াতে পারেন, তবো ইনার নিকট থেকে প্রভূত সাহায্য-সহায়তা পাওয়া যাবে।” দেশবন্ধু তাঁকে যতটা চিনেছিলেন এবং বুঝেছিলেন, তাতে মনে হয়েছিল রাজনৈতিক মঞ্চের অনেক উপরে তিনি; এমন মহান ব্যক্তিত্বকে ক্ষুদ্র সীমায় বাঁধা সঙ্গত নয়। তিনি বললেন, “ইনি কেন যোগ দেবেন আমাদের এই সাময়িক আন্দোলনে। ইনি যে তীর্থ সংস্কারের কাজ আরম্ভ করেছেন তাঁর দ্বারা তীর্থস্থানের হবে আমূল সংস্কারসাধন। আমাদের এই আন্দোলন অনেকখানি রাজনৈতিক, এঁর মত ব্যক্তিকে এর মধ্যে টেনে এনে লাভ নেই। ওঁর আধ্যাত্মিক শক্তির দ্বারা যে মহৎ কার্য সাধ্য হবে, তা আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়।” আরও বললেন, “আপনাকে ধর্মতলার মোড়ে চলাফেরা করতে দেখেছি। আপনার ঐ বিরাট ঋষি-মূর্তি বহুবারই আমার বিস্ময়-দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আপনাকে দেখেই মনে হয়েছে, আপনার মধ্যে একটা বিরাট শক্তি নিহিত রয়েছে। আপনি যে কো, তা জানার জন্য আমার মনে একটা জিজ্ঞাসা জেগে ছিল, আজ আপনার দর্শন পেয়ে ধন্য হলাম।”
অবশ্য মুসলিম তোষণে নেমে ১৯২৩ সালের ১৮ ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বেঙ্গল প্যাক্টের মূল কাণ্ডারি দেশবন্ধুর হয়ে রাজনীতিতে কাজ করবেন এমন ধাতুতে গড়া মানুষ ছিলেন না স্বামী প্রণবানন্দ। কারণ বেঙ্গল প্যাক্ট সম্পাদনা করতে গিয়ে দেশবন্ধু কথা দিয়েছিলেন, স্বরাজ লাভের পর আইন পরিষদে জনসংখ্যার অনুপাতে মুসলমানদের আসন ঠিক হবে এবং তাদের জন্য আলাদা নির্বাচন বহাল থাকবে। কলকাতা, ঢাকা সমেত প্রায় সব মিউনিসিপালিটিগুলিতে মুসলমানেরা সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও তারা ৬০% আসন পাবে। চাকরি ক্ষেত্রে ৫৫% আসন সংরক্ষিত থাকবে। এমনকি সেই হারে পৌঁছানোর জন্য তাদের ক্ষেত্রে ৮০% পর্যন্ত সংরক্ষণ চলতে পারে। অবশেষে ১৯২৫ সালের ১৬ ই জুন দেশবন্ধু অকালে প্রয়াত হলে বেঙ্গল প্যাক্ট বানচাল হয়ে যায়। ১৯২৬ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গা হয় এবং স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে হত্যা করা হয়।
যে মানুষ রাজনৈতিক মঞ্চে প্রবেশ করবেন না, তিনিই এরপর হিন্দু বাঙালির রক্ষাকর্তা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে আপন ঐশী শক্তি উজাড় করে দিতে সঙ্কল্পবদ্ধ হলেন, যিনি পরবর্তীকালে ইংরেজদের কূটনৈতিক চাল উপেক্ষা করে বাঙালি হিন্দুর একমাত্র আশ্রয়স্থল পশ্চিমবঙ্গকে মুসলমান-প্রধান রাষ্ট্র পাকিস্তানের পাতে যেতে দেননি। কে এই শ্যামাপ্রসাদ? তাঁর উপর কেনই বা যুগপুরুষের এতটা আস্থা ছিল? কবিশেখর কালিদাস রায় শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কে কবিতায় লিখেছেন, “শ্যামাজননীর মহাপ্রসাদ শ্যামাপ্রসাদ”। সত্যিই তাই, বাংলাতে শ্যামাপ্রসাদের আবির্ভাব মহাকালীর প্রলয় নৃত্যের মত। তিনি না থাকলে সেইসময়ে হিন্দু বাঙালীকে বাঁচানোর আর কেউ ছিলেন না। মনে পড়বে স্বামী বিবেকানন্দের কবিতা ‘Kali the Mother’ কবিতাটি: “যে দেয় দুঃখে প্রেম মৃত্যুকে ধরে বক্ষে প্রলয় নৃত্যে মত্ত মা-যে আসে তারই চিত্তে।” স্বামী প্রণবানন্দ যখন শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে সখ্যতা তৈরি করছেন, তখন তিনি অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার একজন প্রখ্যাত নেতা। স্বামী প্রণবানন্দ তাঁকে প্রথমাবধি নজর রেখে চলেছেন। বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখার্জীর সন্তান ১৯২৯ সালে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার কলকাতা অধিবেশনে উল্লেখযোগ্যভাবে অংশগ্রহণ করেছেন; তখন থেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট মেম্বার ও সেখান থেকেই আইন সভার সদস্য; ১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ১৯৪০ সাল থেকে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার কার্যকরী সভাপতি এবং বাংলার হিন্দু মহাসভার সভাপতি। রাজনীতিতে এমন একজন হিন্দু শিক্ষাবিদ ও পণ্ডিত ও পরিশ্রমী মানুষ খুঁজছিলেন যিনি সত্যিকারের হিন্দুদের স্বার্থ দেখতে পারবেন। স্বামীজির স্থূল জীবন তখন ফুরিয়ে আসছে, নানান রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে শরীরে। শরীর যাবার আগে হিন্দুদের নয়নের মণি বেছে দিতে চান, তার মধ্যে যাবতীয় যোগশক্তি তুলে দিতে হবে। আর তো তর সইছে না! এখন সত্যিকারের বাঙ্গালি হিন্দু রাজনীতিবিদ একজন দরকার যিনি তাদের হয়ে মুখ খুলতে পারেন; কোনো মুখোশ পড়ার দরকার হবে না।
১৯৩৫ সালে বাজিতপুর আশ্রমে মাঘীপূর্ণিমার উৎসবে ‘বঙ্গীয় হিন্দু মহা-সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন যুগাচার্য। দশ সহস্রাধিক হিন্দু নরনারীর মিলন হল, তাদের নানান সমস্যার সমাধান বিষয়ে আলোচনা হল। এখানে বজ্র গম্ভীর কণ্ঠে তিনি হিন্দুদের মাঝে ঘোষণা করলেন, ভেদ নয়, চাই মিলন, অবজ্ঞা নয়, চাই সহযোগিতা, কাপুরুষতা নয়, চাই বীরত্ব। ১৯৪০ সালের মার্চ মাসের শিবরাত্রি সম্মেলনে স্বামী প্রণবানন্দকে দুঃখ করে বলতে শোনা যায়, “বাংলার গ্রামে গ্রামে ক্রমাগত যে সমস্ত মন্দির ও দেববিগ্রহের লাঞ্ছনা, নারীহরণ, নারী নির্যাতন, দুর্বল অসহায় গ্রামবাসীর উপর অত্যাচার চলছে, তাতে আমি কোন মতে স্থির থাকতে পারছি না রে!” এদিন পাঁচ লক্ষ সেনা নিয়ে শক্তিশালী রক্ষীদল গঠনের কথা ঘোষিত হল, যারা হিন্দুদের উপর যেকোনো আক্রমণের প্রতিদানের জন্য সবসময় তৈরি থাকবে।
১৯৪০ সালের মার্চমাসে শিবরাত্রি উপলক্ষে স্বামীজির আহ্বানে স্যার মন্মথনাথ মুখার্জীর সভাপতিত্বে বাংলার বিখ্যাত হিন্দুনেতা ও হিন্দুত্ববাদী মানুষের এক বৃহৎ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। এই সভায় বাঙ্গালি হিন্দুদের রক্ষা করার প্রয়াসে হিন্দুরক্ষী দল গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হল। স্বামীজি তখন লড়াইয়ে নেমে পড়েছেন; সন্ন্যাসী ও দেশব্রতী কর্মীদের গ্রামে-শহরে নানান জায়গায় রক্ষীদল গঠনের জন্য নিয়োগ করছেন। প্রস্তুত হল রক্ষীদলের নিয়মাবলী; দলের দায়িত্ব, কর্তব্য ও প্রতিজ্ঞাপত্র ছাপিয়ে বিলি করা হচ্ছে। হিন্দুনেতা শ্রী বি. সি. চ্যাটার্জী (বার-এট্-ল) -কে দায়িত্ব দিয়েছেন রক্ষীদল গঠনের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে। স্বামীজি বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং আপামর জনসাধারণ সবাইকেই ডাক দিয়েছেন লড়াইয়ের ময়দানে। বলছেন — স্পিরিট চাই, তেজ চাই, সঙ্কল্প চাই। হাতিয়ার ধরতে হবে পরে, কারণ ঘুমন্ত লোকের কাছে বন্ধুক রেখে লাভ নেই। আগে জাগাতে হবে আম জনতাকে; তাদের মধ্যে তেজ সঞ্চার করতে হবে। আচার্য প্রণবানন্দ বুঝলেন, হিন্দুসমাজকে রক্ষা এবং জনগণের মধ্যে তেজ ও সঙ্কল্প সঞ্চার করতে শ্রেষ্ঠ রক্ষী হতে পারেন ড. শ্যামাপ্রসাদ। ১৯৪০ সালের আগষ্ট মাস, জন্মাষ্টমীর পবিত্র তিথি; ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের আয়োজনে কলকাতার বালিগঞ্জে আহুত হয়েছে এক বৃহৎ হিন্দু সম্মেলন। কলকাতার বিশিষ্ট নাগরিকগণ ও নেতৃবৃন্দ উদ্যোগী হলেন। কারণ হিন্দুধর্মের মূর্ত-বিগ্রহ, হিন্দু-জাতিসংগঠক শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথিটি এক বীররসে সম্পৃক্ত দিন। তাঁরই বীরবাণী ও দুষ্টদমন-লীলার মধ্যে হিন্দুজাতির আপন কর্তব্যবোধ লুকিয়ে আছে। সেসময় বাংলার দিকে দিকে হিন্দু জাতির উপর বিধর্মী মুসলমানদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে মহাধ্বংসের বিভীষিকা। হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী প্রণবানন্দ তাতে যারপরনাই উদ্বিগ্ন। বাঙালি হিন্দুকে রক্ষার আবেদনে সাড়া দিচ্ছেন না কোনো বাঙালি হিন্দু নেতা, পাছে হিন্দুকে রক্ষার বিষয়ে মুখ খুললে তার নামের পূর্বে ‘সাম্প্রদায়িক’ কথাটা যুক্ত হয়ে যায়, পাছে রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে ব্রাত্য হয়ে পড়েন! হিন্দুদের দুর্গতির বিষয়ে সম্যক জেনেও চুপ করে রয়েছেন বাংলার এবং ভারতের তাবড়-তাবড় নেতৃবৃন্দ। বাংলার অসহায় হিন্দুদের বাঁচাতে প্রণবানন্দজী সঙ্কল্প করলেন, মাধ্যম নির্বাচন করলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে দিয়ে। প্রস্তুত হিন্দু সম্মেলনের সভাপতি হবেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে আর উদ্বোধন করবেন মাননীয় বিচারপতি স্যার মন্মথনাথ মুখার্জী। আচার্যদেব ডাক দিলেন, আত্মরক্ষাই প্রত্যেক জীবের, প্রত্যেক মানুষের স্বধর্ম…… আত্মরক্ষার উদ্যম ও সামর্থ্য যার নেই, কোনো ন্যায়বোধের অনুশাসন, যুক্তিতর্কের ধর্ম, মনুষ্যত্বের আবেদন তাকে কদাচ রক্ষা করতে পারে না। শক্তি সংগ্রহের উপায় — সঙ্ঘবদ্ধতা। আচার্যের ডাকে সাড়া দিলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ, যদিও তিনি হিন্দুমহাসভার কাজে দেশ জুড়ে নানান কাজে ব্যস্ত। কারণ আচার্যের মত তিনিও যে বিশ্বাস করেন, হিন্দু জাতি শান্তিপ্রিয়, উদার। নিরর্থক কারো ধন, সম্মান, স্বার্থে আঘাত দেওয়া তার স্বভাব নয়। অপরকে বঞ্চিত করে অন্যাশ অধিকার সে চায় না। কিন্তু অন্যায়-অত্যাচারও সে সহ্য করতে প্রস্তুত নয়। সম্মেলনে শ্যামাপ্রসাদকে পাবার জন্য এবং তার সঙ্গে সম্মেলন উপলক্ষে বিশেষ আলোচনার জন্য এবং তার প্রতি আশীর্বাদ ও শক্তি সঞ্চারের জন্য পর পর পাঁচ দিন সঙ্ঘসন্তানদের পাঠালেন, যাতে কলকাতা কার্যালয়ে তিনি এসে উপস্থিত হন। শ্যামাপ্রসাদ সাড়া দিলেন আসবেন তিনি, কিন্তু হিন্দু মহাসভার কাজের চাপে পাঁচ দিনের একদিনও আচার্য সামীপ্যে উপস্থিত হতে পারলেন না, রোজই সন্ধ্যা সাতটায় শ্যামাপ্রসাদের জন্য পথ চেয়ে বসে থাকেন স্বামীজি। এদিকে অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে শ্যামাপ্রসাদ আচার্যকে খবর পাঠালেন, “আমি কথা দিয়া কথা রক্ষা করিতে পারিতেছি না; আমাকে ক্ষমা করিতে বলিবেন। সম্মেলনের দিন ছাড়া তাঁর দর্শনের সুযোগ আমার ঘটিবে না।” আচার্য বিষণ্ণ হলেও নির্ধারিত দিনে নির্ধারিত সময়ে বালিগঞ্জ আশ্রমের প্রবেশদ্বারের পথে মোটরে বসে রইলেন, কখন শ্যামাপ্রসাদ আসবেন সভায়, কখন তার আত্মপ্রত্যয়ী মুখ দেখবেন এবং দেখাবেন উপস্থিত যোদ্ধা-ভক্তমণ্ডলীকে। শ্যামাপ্রসাদ কিছু সময়ের মধ্যেই উপস্থিত হলেন আশ্রমে, হাজার হাজার দর্শকমণ্ডলী। হিন্দুনেতাকে মঞ্চে তুলে নিজের গলায় পরিহিত প্রসাদী মালা কণ্ঠে জড়িয়ে দিলেন স্বামীজি, সভা বাকরুদ্ধ, শ্যামাপ্রসাদের মুখে এক অনির্বচনীয় প্রশান্তি! ড. শ্যামাপ্রসাদকে শক্তি দিয়ে দাঁড় করাচ্ছেন স্বামীজি।
জাতীয় জীবনে মহাশক্তি সঞ্চারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ স্বামী প্রণবানন্দ। শক্তির সাধনা প্রবর্তন করতে দেবী দুর্গার আরাধনায় রত হলেন তিনি। এই দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করেই ড. শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে তাঁর রুদ্ধদ্বার বৈঠক হল হিন্দুতীর্থ কাশীধামে। ১৯২৮ সাল থেকে সঙ্ঘনেতা সঙ্কল্পিত দুর্গাপূজার আয়োজন হয়ে আসছে। ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত জাতীয় জীবনে শক্তি সাধনার সঙ্কল্প সঞ্চারের জন্য দুর্গোৎসবকে ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ করেছেন। ১৯৩৬ সাল থেকে জাতিগঠনমূলক কার্যকরী রূপদান শুরু হল। তার তাৎপর্য বোঝবার জন্য হিন্দু সম্মেলনের আয়োজন করলেন তিনি। হিন্দুজাতি ও সমাজের যুগনির্মাণ ও হিন্দু সংহতি-শক্তি গঠনের ঈঙ্গিত। এ রকম একটি অনুষ্ঠানে ড. শ্যামপ্রসাদকে ডেকে পাঠালেন তিনি। ১৯৪০ সালে আচার্যের আদেশে স্থানীয় হিন্দু-নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে সঙ্ঘের কাশীতীর্থ সেবাশ্রমে দুর্গাপূজা উপলক্ষে হিন্দু সম্মেলনের ডাক দেওয়া হয়েছে। স্থূলশরীরে কাশীতে সেবারই তাঁর শেষ দুর্গাপূজা। সঙ্ঘসন্তানদের বললেন, “শ্যামাপ্রসাদকে নিয়ে এস।” সন্তানেরা অবাক, “তিনি কি এখানে এসেছেন!” স্বামীজি বললেন, হ্যাঁ। সন্তানেরা বিস্মিত, কারণ খোঁজ নিয়ে দেখলেন, সত্যিই তখন শ্যামাপ্রসাদ কাশীতে অবস্থান করছেন। মহাষ্টমীর দিন তিনি এলেন। যুগাচার্য অনেকক্ষণ তাঁর সঙ্গে কথা বললেন, দান করলেন নিজের বিশেষ শক্তি। বলেই দিলেন, “বাঙ্গালি জাতির সামনে দাঁড়ানোর একটা লোক ঠিক করে দিয়ে গেলাম। আহা! আমার ভাব যে শ্যামাপ্রসাদই কিছুটা বুঝেছে।” তখনও সরকার, শাসন-ক্ষমতা শ্যামাপ্রসাদের হাতে ছিল না। সেদিন যুগোচিত প্রয়োজন বোধ করেছিলেন স্বামীজি; তাইতো একজন সৎ, নির্ভীক, আদর্শবান রাজনৈতিক নেতাকে নিজের শক্তি দান করলেন। একজন অধ্যাত্ম-জগতের সন্ন্যাসী দেশ ও জাতির কল্যাণে সর্বাঙ্গীন দায়িত্ব পালন করে তার সঙ্গে শ্যামাপ্রসাদকে জুড়ে দিলেন। অথচ রাজনৈতিক এক্তিয়ারের মধ্যে নিজেকে জড়ালেন না। নিজের গলার মালাটি তাঁর গলায় পরিয়ে দেওয়ার অর্থ হল, তুমি যন্ত্র আমি যন্ত্রী।